Saturday, September 25, 2021

মেটামরফোসিস

 

মেটামরফসিস 






অবশেষে এক আশ্চর্য ছায়াসম্ভব আলো আমায় নিষ্কৃতি দেয়- বেতস সুষুম্না ভিজে উঠছে স্নানজলে, শৈবলিনী চোখ বুজে সদ্যোজাত তাপে স্বস্তি খুঁজছিলেন অথবা আঁকতে চাইছিলেন। একাই যে পথ পেরিয়ে এলেন এতোদিন, যার শুরু ছিলো যৌথতার প্রতিশ্রুতি দিয়েই, এমনও বলা যায় যৌথতার নিমিত্তেই মন্ত্র দিয়ে গেঁথে যে জীবন নির্মাণের চেষ্টা হয়েছিলো, শুধু কি তার একারই দায় ছিলো তাকে ধারণের? বহমান রাখার ? এমনকী হয়তো শেষ সমাগত, এই শ্বাসেরও? প্রশ্ন আসে না আর। পথ দীর্ঘ হলে তার ক্লান্তি পথিককে গন্তব্য প্রসঙ্গে উদাসীনতা দেয়, যে কোনো দীর্ঘতর দৈর্ঘ্যের এইই সাফল্য। 




খুব সহজ ছিলো না। অনভিজ্ঞ ষোড়শী ছিলেন। সতেরোতে মা, উনিশে দ্বিতীয় সন্তান, তেইশে কাশের রঙে প্রায় সাংবিধানিক স্বীকৃতি। এও এক রহস্য। যে মেয়েটি লাল রঙ ভালোবেসে বড় হলো, আমিষ গন্ধ ছাড়াও যে ভাত মাখা যায়, বিশ্বাস করতে শিখলো না, তার নর্ম সহচর পঞ্চভূতে বিলীনের সঙ্গে সঙ্গে সেই রঙ সেই অন্নঘ্রাণই তার কাছে নিষিদ্ধ, কী করে যে এই ফতোয়া দেওয়া যায়...কই জায়া বিয়োগে তো এমনটি হয় না, এমনকী প্রভু-ভৃত্য পরম্পরাতেও নয়, তাহলে এই অদ্ভুত নীতি শুধুমাত্র এক ব্যতিক্রমে কেন? শৈবলিনী এভাবে ভাবেননি, তার সন্তানেরা ভেবেছিলো। ধ্রুপদী সুন্দর মা'কে বোধ হওয়া ইস্তক শুধুই শুভ্রতায় দেখতে দেখতে তাদের ক্ষোভ এমনই পর্যায়ে পৌঁছেছিলো বিস্তীর্ণ বাগান আলো করে থাকা জুইঁ আর কুন্দ ঝাড়ের একটি ফুলকেও রোদ্দুর ওঠার পরে গাছে দেখা যেতো না। ঋজু ব্যক্তিত্ব অভেদ্য প্রাচীর হয়ে তার সঙ্গে তার সন্তানদের অনাবিলে বাধা হয়ে থেকেছে বরাবর। মা'কে তারা তাদের হাস্য পরিহাসের অংশে পায়নি কখনো। ভাবতে ভাবতে শৈবলিনী ভিজে ওঠেন ভিতরঘরে। তিনি অপরাধী কি? বিশাল এক জীর্ণ অট্টালিকা, অকালপ্রয়াত স্বামীর অপরিকল্পিত সামান্য সঞ্চয় দিয়ে দুই সন্তানকে যে নারীর একা হাতে 'মানুষ' করে তুলতে হয়েছিলো সত্তরের দশকে, চৈতন্যে পুঁতে দিতে হয়েছিলো অর্থের সঙ্গে আভিজাত্যের কোনো সম্পর্ক থাকে না, থাকে আত্মাভিমানের- এই দর্শন, শুধু সেইই জানে নিরেট গাম্ভীর্য কোনো বর্ম বা মুখোশের মতো আত্মরক্ষার অধিক প্রত্যাঘাতের নাম। এ বাসরে ছিদ্রের অধিকার তিনি দেবতাদের দেননি ফলত দানবেরা অনুপ্রবেশের পথ পায়নি। 



মাটি যে কতদূর ভারী ঠেকলে কেউ স্বেচ্ছায় জলজ হতে চায় শৈবলিনী সেদিন টের পেয়েছিলেন যেদিন তার বাইশ বছরের ছেলে ইণ্ডিয়ান নেভির  নিয়োগপত্র হাতে মায়ের অনুমতি নিতে এসে দাঁড়িয়েছিল। শৈবলিনী বন্দরের থেকে বেশী বাতিঘর হতে চাওয়ায় সে বাধা পায়নি কোনো। তিনি জানেন, সামান্য বিরোধ প্রত্যাশিত ছিলো মায়ের তরফ থেকে স্বয়মের, অপত্য হলেও সে পুরুষ, যাদের দৃষ্টি বুঝতে তার এক পল মাত্র লাগে। কিন্তু শৈবলিনী বিশ্বাস করেন বিচ্ছেদ তুল্য মায়াবিস্তার কোনো বন্ধনই নির্মাণ করতে পারে না, সুতরাং অবিচল ছিলেন। 



 গত বছর শ্রী'কে সম্প্রদান করেছেন। সেই শূন্যতায় পুরোপুরি ধাতস্থ হয়ে ওঠার আগেই স্বয়ম তাকে জানিয়ে গেলো ঘোর অরণ্যেও প্রতিটি বৃক্ষের একাকী থাকাই বিধি। এখন তার দিলরুবায় অসীম নৈশব্দ্য। অবশ্য এই দেওয়ালেরা প্রগলভতার অভিজ্ঞতা পেলোই বা কখন? বড় শান্ত মেয়ে ছিলো তার শ্রী। মায়ের কাঠিন্য তার নরমে আঁচড়ের অবসর পায়নি কোনোদিন। কথা সে প্রায় বলতোই না। তার আনন্দ অভিমান যে কোনো তরঙ্গের সামান্য সরণ তাকে রেওয়াজে বসাত। সেই সুরই সম্ভবত তাকে নীলাদ্রীর কাছেও পৌঁছে দিলো, ভাবছিলেন শৈবলিনী। যতটুকু তিনি তাকে দেখেছেন, শ্রী যতই অনিন্দ্যসুন্দরী হোক, "রূপে তোমায় ভোলাবো না" এই স্বীকারোক্তির জায়গা অন্তত নীলাদ্রী নন, এইটুকু বুঝেছেন তাই আশ্বস্ত বোধ করছেন। রিপুজয়ের কথা যারা বলে থাকে তারা সম্ভবত প্রথম ইন্দ্রিয়টিকে নিরীহ জ্ঞানে রাখে। অথচ যাবতীয় ভ্রম ও ভ্রমভঙ্গের দায়ভাগ যদি কিছুকে দেওয়া যায় তবে তা 'চোখ'ই। শৈবলিনীর ব্যক্তিগত বিচারে গান্ধারীর অপরাধ অনেক বেশী ধৃতরাষ্ট্রের সাপেক্ষে। জন্মান্ধের অজুহাত যদিও বা গ্রহণীয় কিন্তু সক্ষমের ভাণজনিত বিকার কোনোভাবেই নয়।




বেলা গড়াচ্ছে। স্বয়ম আর শ্রী থাকার সময় বহুসময় তার উনুনের আঁচে কাটতো। রন্ধনশিল্পে বিক্রমপুরের মেয়ের নৈপুণ্যের খ্যাতি মূলত লক্ষ্মীপুজোর ভোগ হেতু পাড়ায় সুবিদিত ছিল। অবশ্য সে এক এমন সময়ের কথা যখন কোনো সংসারের সব ক'টি তৈজস দিনান্তে নিজের আস্তানাতেই থেকে গেছে, এ'ঘটনাকে বিরল মানা হতো। প্রতিবেশীরা শুধু একটি তথ্য জানতো না, একটা সময়ের পর হাজার চেষ্টাতেও শৈবলিনী তার হেঁসেলে আমিষ রাঁধতে পারেননি। এই একটি বিষয়ে ভাই-বোন দুজনেই অসম্ভব জেদে তাকে হারিয়ে দিয়েছে বারবার এবং প্রতিবার। সামান্য বোধের বয়সে পৌঁছে যেদিন থেকে তারা বুঝতে শিখেছে কী এমন অসুস্থ তাদের মা রোজই এমন হয়ে পড়ে যে তাদের রান্না সেরে স্নান করে ভিজে কাপড়ে নিজের জন্য একটা পাত্রে সিদ্ধ ফুটিয়ে নিতে হয় সারাদিনের নামে, তারা সেই সমস্ত কিছুর স্বাদকে অস্বীকার করতে চেয়েছে যাতে মায়ের অধিকার নেই। ফলে শৈবলিনীকেও হার মানতে হয়েছে। আঁশহীন অজস্র প্রণালীতে সেই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করতে হয়েছে। 'ঘাটতি' - সঠিক শব্দ হলো কি? শৈবলিনীর অহং জাগল। কখনো 'ভালোবাসি' শব্দ উচ্চারণ করেনি তার কাছে তার সন্তানেরা। হাজারো প্রাপ্তিতে উচ্ছল হয়নি। সহস্র অপ্রাপ্তিতেও অভিযোগ আনেনি। অথচ তাদের সংবেদন এতো সূক্ষ্ম যে কীভাবে কবে হয়ে উঠলো তিনি কর্তব্যের ভারে ঠাহরই করে উঠতে পারলেন না। পিতৃহীন সন্তানদের সব মা'ই কি পৃথা?



ভাবতে ভাবতে উঠছিলেন, প্রায়োবেশনে স্পৃহা নেই প্রমাণে পুরনো একাহারী অভ্যাসে ফিরতে। সিংদুয়ারের কড়া তাকে বিচলিত করল। প্রাচীন আবলুশ, লোহার ভারী শিকল, নির্জন ছিঁড়তে যথেষ্ট সক্ষম। হতেই পারে আত্মীয় পরিজন অথবা ফেরিওয়ালা কিন্তু নৈঋতে কাকের কর্কশ তাকে অদ্ভুত অসামঞ্জস্য দিয়ে গেলো। এমনটি যেন হওয়ার কথা ছিলো না। আয়ুর প্রথমার্দ্ধে সামর্থ্য, দ্বিতীয়ার্দ্ধে প্রয়োজন তাকে পরিচারকহীন করেছে। সুতরাং কিছু সময় লাগলো জানতে সদর সংবাদ।


-- " একী ! শিয়া তুমি? চিঠি দাওনি তো আজ আসবে... কী হয়েছে? "


বরাবরের ধীর মেয়ে তার বরফ এখনো


--" ভিতরে আসি? "



হাজারো ঝঞ্ঝাতেও যে নন্দিনীকে তিনি অভিভাবকহীন চারণের অনুমতি দেননি বহু শঙ্কায়, অনেক দ্বিধায়, সে আজ আটপৌরেতে তার সামনে দাঁড়িয়ে। চোখের দীঘল বলে ঘুম হয়নি বিগত বেশ কিছু প্রহর, অবিন্যস্ত চুল হাতপ্যাঁচে ঘাড়ের উপর ফেলা। সঙ্গে সামান্য হাতব্যাগটিও অনুপস্থিত। তার বুক বসে যেতে লাগলো চোরাবালির গতিতে।



স্নান সেরে শ্রী ঘুমোতে চাইলে শৈবলিনী জিজ্ঞাসার চৌহদ্দিও পেরোননি। কুম্ভক তার নিয়ন্ত্রণে। ঘুমোক, যতক্ষণ সম্ভব। যে কোনো বিপর্যয়ে এইই বিশল্যকরণি শরীর মনের ভারসাম্য রাখতে। সন্ধ্যায় শ্রী জানিয়েছিলো অতি সংক্ষেপে। মধুপুরের চ্যাটার্জি ফ্যাক্টরি আর সংলগ্ন বাগান ঘেরা বাংলোটি গত রাতে রাজনৈতিক হিংসার বলি হয়েছে। বোমা, গুলি কিছুই বাদ থাকেনি। বিশ্বস্ত এক সূত্র সামান্য আগে খবর পেয়ে তাদের কাছে লুকিয়ে রাখায় নীলাদ্রি ও শ্রীয়ের প্রাণ দুটি রক্ষা পেয়েছে মাত্র। বাকি সর্বস্ব নিতান্তই ভগ্নস্তূপ এখন। ভোর রাতের প্রথম ট্রেনে শ্রীকে তুলে দিয়ে নীলাদ্রি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে গেছেন অনির্দিষ্ট কাল সময় চেয়ে নিয়ে। বেনারসের আদি বাড়ি অথবা আসানসোলে দাদার কাছে যাবেন, এমন শিরদাঁড়া তার নয়। সুতরাং, তিনি কোথায়, শ্রী জানে না।



কিছু রাত কুরুক্ষেত্রের, কিছু জোনাকির, আর কিছু সংজ্ঞাহীনতার। শৈবলিনী জানতেন না ঠিক কোন স্তরে সে রাতকে ফেলা যেতে পারত। শৈশবে শ্রী'র জ্বর হলে যেভাবে রাতপাহারা দিতেন শিয়রে, ফিরে গেলেন সেই সময়ে। হঠাৎ শিয়ার ঘুমন্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে জন্মদাত্রীর অভিজ্ঞ স্নায়ু তাকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করল। এই প্রবল অন্ধকারের ভিতরে কি কোনো তীব্র আলোর সংকেত লুকিয়ে যা তিনি অনুমান করছেন? ডাক্তার এসেছিল। ধারণা অভ্রান্ত, আনন্দে জানিয়ে ফিরে গিয়েছিল।  




শৈবলিনী ঠিক তিনদিন আগের মতো, আজও সেই সময় একই ভাবে দাঁড়িয়ে। শুধু সেদিন যে 'নিষ্কৃতি' শব্দোচ্চারণ করেছিলেন, তাকে প্রত্যাহার করছেন আজ সজ্ঞানে। যার লগ্নে সংগ্রাম, এত সহজে কি তার মুক্তি আসে? অনির্ধারিত অজ্ঞাতবাসে যাওয়া নীলাদ্রির আগামীকে গর্ভে ধারণ করে শ্রী এসেছে তার কাছে। তার যাবতীয় ছায়া আজ আলোময়। আজ সত্যিই তিনি সিংহের প্রয়োজন বোধ করলেন, রাশি থেকে খুবলে হৃদয়ে প্রতিস্থাপন নিমিত্তে। সন্তান সংকটাপন্ন হলে কোন গর্ভধারিণী অবিকল সিংহবাহিনী নয় আর তিনি তো শৈবলিনী, গায়ত্রীজল সবিতাকে অর্পণ করে বীজস্বার্থে মহাতেজা রূপ পরিগ্রহ করলেন।


কবিতা : নিজা

 

নিজা 


মাউন্ট মৌনালোয়া, ফুজি না নিছক পোপো? বৃষ্টি কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক করে দিয়েছে সায়র সেনকে নাহলে এই সব অহৈতুকী দৃশ্যকল্পের তুলনা মাথায় আসার মতো অবসর কোনো মফস্বলের সরকারী হাসপাতাল তার ডক্টর অন ডিউটিকে দেয় না। সপ্তাহের সিংহভাগ এখানেই কাটাতে হয় তাকে। অন্যান্য অপ্রাপ্তি সেভাবে গুরুত্ব না পেলেও একমাত্র মেয়েকে ছেড়ে থাকাটা মনখারাপেই রাখে। যে আসার পর তার চরাচরে তিনি অন্য রংধনু দেখেছেন তার থেকে দূরত্ব বিষণ্ণতা তো দেয়ই তার মতো মানুষকেও যার জীবন ও তার যাপন সম্পর্কে ধারণাটা মেডিক্যাল ফ্রেটারনিটির বাকি পাঁচজন সমসাময়িকের সঙ্গে মেলেনা। হয়তো মেধা, দক্ষতা এইসব কোন'কে অনালোচিত রাখলে একমাত্র নিয়তি নির্ধারিত বলেই তাকে এই পেশায় আসতে হয়েছে, থাকতে হচ্ছে, হয়তো বা নিজেকেও ভুলতেই হচ্ছে। সদ্য তিরিশ পেরিয়েছেন অথচ তাকে দেখলে কেউ বলবেই না ক্যাম্পাসে বসে কিছুক্ষণ আগেও আড্ডা মারছিলেন না। হয়তো প্রাণশক্তি, হয়তো উদ্দাম স্বাতন্ত্র, সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না এক নজরে দেখে কী তাকে এতটা আলাদা করলো। তবে যদি কেউ তাকে লক্ষ্য করে নিপুণভাবে, বুঝতে ভুল হবে না আসলে এখনো তিনি তার আবেগ ও সংবেদনকে কাটিয়ে উঠতে পারেন নি, এর উল্টোটা ঘটলেই বরং স্বাভাবিক হতো, পেশার সঙ্গে মানানসইও বটে। অথচ সায়র বেহিসাবি সফল। অদ্ভুত শুনতে লাগলেও অত্যন্ত বিতর্কিতও। সেসব অন্য প্রসঙ্গ। এই মুহূর্তে বৃষ্টি বাড়ছে। অন্যমনস্ক থেকে অন্যমনস্কতর হতে হতে সায়রের মনে পড়ছে তার ব্যাক্তিগত মালিকানার নার্সিংহোমগুলোর মধ্যে বিশেষ একটিকে, আরও নির্দিষ্ট করতে গেলে ইডেনের কেবিন ওয়ানকে। কিছু সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হয় নাহলে নিজেকে নৈর্ব্যক্তিক রাখা দুষ্কর হয়ে ওঠে। সায়র ফোন করে নির্দেশ দিলেন, আগামিকাল থেকে ইডেনে কোনো কোভিড পসিটিভ থাকবে না। প্রত্যেককে রেফার, প্রপার প্লেসমেন্ট দিয়ে ডিসচার্জ করে দিতে হবে। প্রয়োজন ছিলো না, কিছুটা স্বগতোক্তির মতো করে জুড়ে দিলেন,

--"গভর্নমেন্ট গাইডলাইন প্রোভাইড করতে গেলে যে অমানবিক আচরণ করতে হবে, পিপিই ইত্যাদি পরে ট্রিটমেন্ট, তা সম্ভব নয়। এতে পেশেন্ট মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। সাইটোকাইন তাকে সেখানেই শেষ করে দেয়। আমায় তো দেখেছেন, একটা মাস্ক ছাড়া কোনো গ্লাভসও আমি ব্যবহার করি না। সুতরাং সকলের স্বার্থে এই ডিসিশন নিতে আমি বাধ্য হলাম।"


জ্যা থেকে শরকে মুক্ত করার পর ব্যাধ ভিন্ন ধনুক নিয়ে ভাবিত হয় না বিশেষ কেউ অথচ ফোন রাখার পর থেকে এক বিচিত্র প্রশ্ন সায়রকে তাড়া করতে শুরু করলো। কেন এই স্টেপ? গতরাতে এডমিশন নিয়ে আজ বিকেলে একজন বলিষ্ঠ মধ্য তিরিশের যুবক স্যাচুরেশন শূন্যে পৌঁছে লাশ হয়ে গেছে বলে? চারঘন্টা যাবত এই আকস্মিকতা নিতে না পেরে তার স্ত্রীর আর্তনাদ ইডেনের সব কটা ফ্লোর জুড়ে ছড়িয়েছে বলে? নাকি সেই একই অলীক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এডমিট হওয়া এক প্রৌঢ়ের একই পরিণতি কাল ঘটলে তিনি দায় নেওয়ার কথা ভাবতেও পারছেন না বলে? জন্ম ও মৃত্যু জনসাধারণের কাছে যতটা প্রবল উদযাপনীয়, ঠিক ততটা প্রেডিক্টেবল নয় অনুভব সাপেক্ষে। চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এত জন্ম এত মৃত্যু, সংখ্যাধিক্য অথবা প্রতিটিতেই অংশীদার হওয়ার কারণে সম্ভবত জীবনের থেকেও অত্যন্ত সহজ ঠেকে তাদের কাছে জীবনে প্রবেশ ও প্রস্থান। তবে কেন তিনি এত অস্বস্তিতে ভুগছেন?

নীলাদ্রি চক্রবর্তীকে ঠিক দুদিন আগে যারা প্রথম ইডেনে নিয়ে এসেছিলো, পরের দিন কথা বলতে এসেছিলো, তাদের কারোর মধ্যে সে ছিলো না। যে মুহূর্ত থেকে যাবতীয় রিপোর্টে অভ্রান্ত প্রমাণিত হলো আপাতত তার আর বাড়ি ফেরার সম্ভাবনা নেই, শরীরের ভিতরের যন্ত্রপাতি ভয়ংকর ক্ষতিগ্রস্ত যেহেতু একদম জ্ঞান হারানোর আগে কাউকে কিছু বুঝতেই দেননি সদাব্যস্ত ব্যক্তিটি, ছায়ার মত সে এসে দাঁড়ালো, নীলাদ্রির একমাত্র সন্তান। সায়র অসংখ্য সুন্দরী দেখেছেন জীবনে, রূপ তাকে আর প্রভাবিত করে না। আর সবচেয়ে বড় বিষয়, একজন প্রৌঢ় পেশেন্টের মেয়েকে কীরকম দেখতে সেই অনুসন্ধানের পর্যাপ্ত আগ্রহ, ইচ্ছে বা উদ্যোগ সবেরই বিপুল ঘাটতি ছিলো তার দিক থেকে। তিনি শুধু এড়াতে পারেন নি একজোড়া চোখকে। চোখও নয় ঠিক, দৃষ্টিকে। মুখের নব্বই শতাং মাস্কে ঢাকা অথচ সেই আয়নার উপর আলো পড়লে আর এক শতাংশেরও প্রয়োজন হয় না বুঝে নিতে মালিকানা পৃথিবীর তিনভাগের থেকে আলাদা। অসম্ভব অসহায় অথচ অন্তর্ভেদী। সায়র যতক্ষণ কেবিনে ছিলেন স্পষ্ট বুঝছিলেন, সেই নি:স্ব রকসলিড দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করছে। তার প্রতিটি কথা, মুভমেন্ট, শরীরী ভাষা সব কিছু স্ক্যান হচ্ছে। কথা হয়নি কোনো। কথার প্রয়োজন ছিলো না। একথা নির্মম সত্য পৃথিবীর যে কোনো ভাষা চতুর্থ ইন্দ্রিয়ের উচ্ছিষ্ট হলে অর্থহীন হয়ে যায়। সায়র অন্ধ নির্ভরতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ফলত বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন অবশ্যই। উচ্চারণ করতে পারেন নি খুব বেশী আশা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না কারণ তার মাথায় ভাসছিলো নিজের মেয়ের মুখ। বছর খানেক আগেও তিনি একথা জানতেন না এখন যা অনায়াসে বোঝেন, একমাত্র মেয়েদের কাছে তাদের বাবারা ঠিক কোন অবস্থানে থাকে। আঘাত করা যায়না সেই শক্তিস্থল অথবা দুর্বলতম বিন্দুতে, চিকিৎসক হিসেবেও নয়। তার চেয়ে এই ভালো, প্রফেসর অন্য কোথাও শিফট হয়ে যান।


নীলাদ্রি ঘুমোচ্ছেন, তাকে নিয়ে এত উথালপাথাল, অজ্ঞাত তিনি। চাঁদের বিন্দু বিসর্গ উদয়ের সম্ভাবনা আপাতত নেই অথচ তার অবচেতন জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। বিস্তীর্ন দিগন্তের একপ্রান্তে এক রাজপুত্তুর, মুকুট তরোয়াল পক্ষীরাজ কিছু নেই, সদ্য দেখেছেন অথচ মনে হচ্ছে বহু চেনা, আরও বহুবার বহু সময় ধরে তাকে দেখতে ইচ্ছে আসছে তার। আর বহুদূরে স্বধা, মেয়ে হিসাবেই তার পরিচয় অথচ নীলাদ্রি বিশ্বাস করেন তার প্রয়াত মায়ের প্রায় সমস্ত বৈশিষ্ট্য মননে বহন করা চলা আত্মজাটি প্রকৃতই তার আত্মারই পরিবর্ধিত রূপ। দৈর্ঘ্য, রঙ ইত্যাদি জাগতিক মাপকাঠিতে যতই স্বধা তার মায়ের জলছবি হোক না কেন, একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করলে অথবা কাগজে হিজিবিজি কাটলেও জনকের সিলমোহর নিয়েই করে, এ তার অপ্রকাশিত অহং জীবনভোর যেদিন থেকে তিনি 'বাবা' ডাক শুনেছেন। রক্তের দোষেই তারা বংশপরম্পরায় গ্রন্থকীট। গণিতশাস্ত্রে যতটা ব্যুৎপত্তি তার ছিলো বা আছে, সাহিত্য তাকে সেভাবে টানেনি কখনো অথচ মেয়ে উল্টো হয়েছে। বিজ্ঞান স্বধার কাছে বিরক্তিকরই থেকে গেলো। ঘুমের মধ্যে স্মিত এক হাসি তার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে ফুটে উঠল। স্বধা দেখলো তাকিয়ে। এই এক্সপ্রেশন জন্মইস্তক তার আর বাবার ব্যাক্তিগত ও পারস্পরিক সংলাপ। সকলেই বলে সে আর তার বাবা দুই ভিন্ন গ্রহের অধিবাসী। কিছুতেই কোনো সামঞ্জস্য নেই, মতের মিল তো নৈব নৈব চ। অথচ সে আর তার বাবা'ই শুধু জানে কেন্দ্রাতীগ বলের সংজ্ঞা। সাধারণ চোখে তা অনুধাবনযোগ্য নয়, প্রমাণের তো নয়ই। সেই সূত্রে সে আজও জানতে পারলো তার বাবা এখন কী দেখছে। 

স্বধা চোখ বন্ধ করে ছায়াপথ ভাবল একবার। নিমেষে শহরতলীর যাবতীয় বারিষকে মেক্সিকোর রক্তাভ মাটির ধোঁয়া ঢেকে দিল। নীলাদ্রি আর ফুয়েন্তেসের গ্রিঙ্গো একাকার হয়ে গেলেন। লড়ছে তার বাবা। কর্তব্যের চাঁদমারিতে দাঁড়ালে কোন পুরুষ ভাড়াটে সৈনিক নয়? বিরোধে বিরোধে বাবাকে জর্জরিত করা সে দাঁড়িয়ে আছে সামনে আর অবাস্তব মায়া আগলে তার বাবা খুঁজে চলেছে সেই পুরুষ যে তার অবাধ্য আর অসামাজিক সন্তানটাকে ধারণ করতে পারবে পূর্ণ যোগ্যতায়, মর্যাদা দিতে পারবে আপাত পাথুরে স্তর পেরিয়ে অসম্ভব তরল সেই জলাভূমির যেখানে যখন তখন তুফান ওঠে বিনা সংকেতে। প্রতিপক্ষ মাত্রেই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় তার স্বধার সামনে এ তার কাছে বিষম যন্ত্রণার কারণ তিনি জানেন প্রতিটি আঘাত দেওয়ার আগে স্বধার নিজের ক্ষত হয় চতুর্গুণ, আত্মধ্বংসী নন্দিনী তার। কে বুঝবে তার এই মেয়েকে? 


ভোর হয়ে আসছে।
ইডেনের রিসেপশন স্টাফ কেবিন ওয়ানের পেশেন্ট পার্টিকে ডেকে পাঠালো, জরুরী ইনফরমেশন আছে, স্যার ফোন করেছিলেন...

 


কবিতা : অ-প্রেমের গদ্য

 অ-প্রেমের গদ্য


সোনালী চক্রবর্তী


মাথার ভিতর সমরাস্ত্রের মতো শব্দেরা সার বেঁধে দাঁড়ায়,
চোখের সামনে দিল্লী দূর,তবে চলন যেন যথেষ্ট বক্র ও সর্পিল হয়,
এইসব কৃত্রিমতার নন্দী ভৃঙ্গীতে আর যাই হোক,
শরতের সারল্য নিয়ে কবিতা হেসে ওঠে না,
প্রেমকে শিউলি ডাকলে কাশেরা অভিমানে পাশ ফেরে,
এই সঙ্কটে কোনদিকে যাই?
অথচ ইচ্ছের হুকুমত,
আজ একটা প্রেমের কবিতা চাই....


ঝিন্টিরা কখনও বৃষ্টি হয়না,
অমলরাও করেনা রোদ্দুরে স্নান,
কিন্তু এখন লুনী প্লাবন সম্ভবা,
জায়েজ,শবরীমালায় ঋতুস্নান....
আচার্য দিয়েছিলেন ব্রহ্মচর্যে দীক্ষা,
চক্র অক্ষে গার্হস্থ্যের দুর্মর টান,
তুষার মোম জেনেছে জ্বলন্ত গলনের সুখ,
সিলিং ফ্যানের স্তব্ধতা,
নন্দন নগ্নতা,
মুহূর্ত ঋষ্যমূক.........


সুরাহীন নেশার উন্মাদ জাল,
জেনে রাখো চণ্ডাল, 
তোমার প্রেমে,
আমি ডাকিণী চিরকাল..... 

 

কবিতা : ধ্রুব

 

ধ্রুব

কে যে ছিঁড়ে দেয় নভের নাড়ি থেকে উল্কাফুল,
হুতাশ ধর্ষণে ক্লান্ত ব্রহ্মাণ্ড, নতমুখ মরুৎ।
সমান্তরালের সংজ্ঞা শেখায় নির্বাক ইস্পাত লাইন,
কেন যে দুরত্ব বরাবর গন্তব্যের অধিক কঠিন।
আতসউপদ্রব মুছতে পারে হিমের বিষাদ?
শিকড় অব্যক্ত রাখে ধৃতি আর বৃন্তের অসম্পূর্ণ আলাপ।

নশ্বরতার কাল শীতঘুম মেনে আমি পেরিয়ে যেতে পারি
জৈবিকতার যাবতীয় দাবী,
শুধু নাভিমূল ভাসান বেলায়,ঢেউ ছুঁয়ে শিখে যেও,
কোটি বর্ষ পেরোলেও ফুরোয় না,

মৃত্তিকা ও নক্ষত্রের সালতামামি।


 

সোনালী চক্রবর্তীর 'মমিস্রোতে বেহায়াসিন্হ' কাব্যগ্রন্হ থেকে চারটি কবিতা

"শূন্যতা ফুরোলে
শ্বেতপাথরকে জড়িয়ে থাক আগুনের সাপ, দেখো নাভি থেকে কিছু ব্যথা ফ্লেমিংগো হয়ে উড়ে যাচ্ছে শেষ সন্তের খোঁজে। আদরের মতো গেঁথে আছে কাদায় ব্রাহ্মমুহূর্তে নিভে-যাওয়া চিতার সোহাগিনী খই। যে-তিল থেকে অপেক্ষা ধুয়ে গেছে তাকে ছত্রাক ভালোবাসছে খুব, যে-বৃষ্টিতে চাঁদ ভিজছে না, তাকে বরং তুমি রক্তের ঝরোখাটুকু দাও। নিরাসক্তির বিপুল এক ঘোরে আছ জানি, নিঃস্ব হ’তে-হ’তে আমিও তো ভুলে গেছি কবে, যদি সব কিছুরই শেষ থাকে তবে শূন্যতারও আছে।"
নর্ম্যাল ই হতে পারলাম না জন্ম ইস্তক তার আবার নিউ...
"নিউ-নর্ম্যাল
বহুদিন লিখতে না-পেরে টাইমমেশিনে চেপে ঘুরে-আসা গেছে রজঃনিবৃত্তির দেশ। দুপুর দেখতে-দেখতে নকশায় এসেছে কীভাবে খুরপি দিয়ে পড়ন্ত শ্যাওলা থেকে উপড়ে ফেলা হবে আলগা রোদের খুঁটি। তর্জনীতে দরদ না-থাকায় গুহায় কোনো এস্রাজ এই সময়ে নদী হয়ে বাজেনি। তবুও তন্‌হা লাল মাটি নির্ধারিত জলে ভেসেছে বেশ্যার নিষ্ঠায়, আর পিলেটের আংটি গলিয়ে তুমিও ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছ চাঁদের টুঁটি। আমি এরপরেও বুঝব না, পুঞ্জাক্ষি নিয়েও কেন আজীবন কানা থেকে যায় সব, সব ক’টা মাছি?"
"ইনফের্‌নো
কখনো রসনীতির উল্কি গাঁথতে-গাঁথতে ভেবো তো...এমনও তো হ’তে পারে মেয়াদ ফুরিয়ে নির্বাসিত হয়েছেন ঈশ্বর। জন্মের পর জন্ম...রাষ্ট্র, রেল, রুটি, রক্ত এসব ইকেবানা সাজাতে-সাজাতে হেরে-যাওয়া দলটা শুধু ধরতে পারে না, ঠিক কতটা বেলজিবাব শিরায় ঢোকালে মধুরেণ ঠেকবে সাড়ে চারশো কোটি বলিরেখা আঁকা মহাগোলকের ইনফের্‌নো।"
"প্যালিনড্রোম
যেভাবে প্রতিটা একলা মানুষ অধিকতর একলা হ’তে চেয়ে দীর্ঘ কোনো মিছিলে হাঁটে, আমিও গুছিয়ে রাখি একান্তের উজ্জ্বল খুঁটিনাটি, ভাঙা আদর, রঙিন জোড়াতালি, নেশার ধূসর কৌতুক কিছু আর প্যালিনড্রোমীয় স্মৃতি। সন্ধ্যা নামলে সালতির কুপিগুলি স্থলের কঠিন থেকে সলতে বোধ হয়, কত যে ফল্গুর এখনো পোড়া বাকি...ভাবো তো, আবর্তন ব’লে আদৌ কিছু হয় কি? যে-কাশের দেউলে তুমি গাত্রহরিদ্রা এঁকেছিলে, গেল পূর্ণিমায় তা ময়ূর মুছে লবণ হয়ে গেছে, যে-চ্যুতি থেকে শিশু অশ্বত্থ আলোর হামা টানছিল, এখন হোম স্টে-য় পরিত্যক্ত বীর্যের চাষ করে। অথচ শূন্য আর দুই নিয়ে আজ একের যত হাড়হাভাতেগিরি। আয়নাকে হরবোলা মনে ক’রে আমি খুলে রেখেছি আঙুলের চামড়া থেকে নখরা, গ্রীবা থেকে হাঁস, পিঠ থেকে রডোডেন্‌ড্রন, সবই...স্মৃতি ফিরে এলে জৈন চন্দ্রাতপটিতে খুঁজো, যক্ষেরা দূত হয়, দাস হবে না ভেবে সিসিফাস যক্ষীরা বয়ে যায় জন্ম-জন্মান্তর ধ’রে ঝলসানো মাটির দায়।"

 

Poet and philosopher Sonali Chakraborty on DEATH

Sonali Chakraborty with Zobaen Sondhi in Ongshumali Shilpasondhi

কবিতা পাঠ করছেন সোনালী চক্রবর্তী বইতরণী উৎসবে

সোনালী চক্রবর্তীর কবিতা "অবতার" মলয় রায়চৌধুরীর কন্ঠে

হোম কোয়ারেনটাইন বিষয়ে কবি সোনালী চক্রবর্তীর বার্তা

সোনালী চক্রবর্তীর কবিতা "শোকপ্রস্তাব" ---- মলয় রায়চৌধুরীর কন্ঠে

KOBITA II কবি সোনালী চক্রবর্তী

KOBITA II কবি সোনালী চক্রবর্তী

সেলেনা

 



সেলেনা




--"দিদি, আকাশে কী রে? ক্রাইস্টকে মিস করছিস নাকি? সত্যি বলবি।


--"বলতে পারিস শিশু, উন্মাদ আর নেশারু এই তিনশ্রেণী ছাড়া কার উচ্চারণে শুদ্ধ সত্য সমাহিত থাকে? এখানে তুই অবশ্যই আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করবি 'সত্য' বলতে কী বুঝি সেও জানি সুতরাং ভেঙেই বলছি, আমি উল্লেখ করছি 'শুদ্ধ' বলে একটি শব্দ যার কাছাকাছি ব্যাখ্যার শব্দ হলো আনবায়াসড, প্রভাবঅদুষ্ট। এ যেন ঠিক এন্টিইনকামবেন্সি। সরকারকে নির্বাচিত করছি না কোনোবারেই, বাকি কোনো পক্ষ যাতে শাসনভার না পায় তাকে সুনিশ্চিত করছি। বিরাট আয়রনি। যাই হোক, বড় বেশী জড়িয়ে যাচ্ছে। দাঁড়া পেগটা শেষ করি। "


ক্যামেরা আবিষ্কার না হলে যে কোনো প্রাণ বা জড়ের বিবর্তনজনিত প্রতিটি রূপেরই যে নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, এত সহজে ধরা পড়তো না। হালিশহরের প্রায় ভগ্ন তিনমহলার চিলেকোঠায় বসে এইসব বলতে বলতে ভাবছিলো স্বধা। সে আর ভাই। শৈবলিনীর দুই সন্তান। স্বধা দৌহিত্রী আর শুভ পৌত্র। যদিও শুভ তার দিদির ঠিক পাঁচ বছর পর প্রথম সূর্য মেখেছে কিন্তু সে পার্থক্য নিতান্তই সংখ্যা মাত্র হয়ে থেকে গেছে তাদের ব্রীজে। অথচ তাদের দেখা হয় তিন চার বছর পর পর অবশ্য ছোটবেলায় বছরে বার তুই তিনেক করেই হতো। শুভর বাবা কর্মসূত্রে বরাবরই বাইরে বাইরে অতএব অপত্যও পরিযায়ী ইচ্ছে বা অনিচ্ছায়। নাড়ি, রক্ত ইত্যাদি অর্বাচীন আলাপ দূরে রাখলে বলা যায় ওয়েভ যদি কানেক্ট করে, কোনো টানেরই সংজ্ঞা লাগে না।


দুই ভাইবোনেরই জন্ম ইস্তক অসীম আকর্ষণ ভাঙা আলসে জুড়ে প্রাগৈতিহাসিক অশ্বত্থের ছায়াঘেরা এই বাড়ির প্রতিটা বন্ধ, তালাভাঙা, অব্যবহৃত ঘর, কুঠুরি, ভূপৃষ্ঠের রেপ্লিকার মত ছাদ আর আগাছাময় আদিম বৃক্ষসবুজ উঠোন বাগানের গর্ভ চিরে গঙ্গায় নেমে যাওয়া সিঁড়ির প্রতিটি বাঁকে। অনন্তের এক টুকরো বোধ হয় অজ্ঞাতে বা জ্ঞাতার্থেই ছেড়ে রেখে গিয়েছিলেন সৃষ্টিকর্তা এই ভিটেতে। মাটি আর শ্যাওলার মধ্যে মিশে বাঁচতে বাঁচতে শিকড় হয়ে যাওয়া বাস্তুসাপ'দের মতো তারই গুঁড়ো ছড়িয়ে আছে আজও আনাচ কানাচে। যে পায় সে পায়। অজস্র অখ্যাত কাহিনীরা গেঁথে আছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নব্বই দশকে শৈশব কাটানো ছেলে মেয়েরাই সম্ভবত শেষ প্রজন্ম যারা দীর্ঘ, অতি দীর্ঘ গ্রীষ্মে টানা একমাস ছুটির অপেক্ষা কী জানতো, জাম আর জামরুলের পার্থক্য গুগল সার্চ না করে বলতে পারতো, দুপুরে খেয়ে উঠে মাদুরের আলস্যে ঠ্যাং ছড়িয়ে ঠাম্মা দিম্মার পিতলের পানবাটার উপর সাম্রাজ্য বিস্তার করতো আর চোখ লেগে এলে বুরাতিনো- টকাই -গোগোল -টিনটিন -সাবুর সঙ্গে ঘুমের মধ্যে টই টই চষে বেরাতো। স্বধার হটাত করেই একটা লাইন মনে পড়ে গেলো "বয়স হচ্ছে বলেই বোধ হয় হাঁটতে হাঁটতে একলা লাগে"। হেসে উঠলো। শুভ না তাকিয়েই বলে উঠলো-


--"মনে পড়ছে না রে দিদি? তুই আর আমি তো সিওর ছিলাম কুয়োতলার ইঁটের পাঁজাটার নিচে গুপ্তধন আছে। কুয়োটা সুড়ঙ্গ। নাহলে ওভাবে পরিত্যক্ত বদনাম দিয়ে ফেলে রাখবে কেন দুটোকেই। উপরে আবার রাশি রাশি গাছ। নিশ্চয়ই বর্গীদের কাজ। "



এবার দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠল, অট্ট সে হাসি। যেভাবে শৈবলিনী প্রতি সেকেন্ডে দশ বছর বেশী আয়ু পেতেন এই হাসি দেখে কোনো এক অতীতে, তার হয়ে এই প্রাচীন অট্টালিকা আজ সেই দায়িত্ব পালন করলো। 


--"সত্য...
    নয়?

সেদিন সেই মুহূর্তে ঐ বিশ্বাস আমাদের সত্য ছিলো শুভ। আজ যা নিয়ে আমরা হাসছি, তাকিয়ে দ্যাখ, চাঁদ গলে মিশে যাচ্ছে সেই ইঁটেরই পাঁজায়। ফিরে যা আমাদের শৈশবে। দ্যাখ দুটো বাচ্চার বিশ্বাস আগলে কীভাবে আজও যক্ষ হয়ে আছে ভগ্নস্তূপ। একি তার সত্য নয়? তুই আমি পেরিয়ে এসেছি। সে আগলে আছে বিশ্বাস। আমাদের আগেও, আমাদের পরেও, নিয়তির মতো। যদি এ সত্য না হয় তাহলে তুই আমি মিথ্যে, এই ছাদ মিথ্যে, চাঁদ মিথ্যে। "



--" দিদি, তোর লেখাতেও চাঁদ, কথাতেও চাঁদ। এতো কী পাস বল তো? আমি প্রশ্নই করছি রে। আহত হোস না আবার শুভটাও "এট টু ব্রুট" হয়ে গেলো বলে। আমি জানতে চাইছি। তোর কিছু থাক না থাক, নাক তো গণ্ডার। কেউ প্রশ্ন করলেই বিদ্ধ হোস আমি জানি। ভাবিস ব্যাখ্যা চাইছে তোর আপাত দুর্বোধ্যতার। আরও গুটিয়ে ফেলিস নিজের ভিতর নিজেকে। ফলে জানা হয়না। "

--"তুই তো জ্যাভেরিয়ান, লুনার এক্লিপ্সের বাংলা জানিস? "


--"এমন করে ঠুকিস যেন তুই কারমেলার নোস। চন্দ্রগ্রহণ জানবো না কেন? "

শুভর এবার রাগ উঠছিল। বরাবর এইরকমই থেকে গেলো দিদিটা তার। কোনো কথার সহজ উত্তর দিতেই জানেনা। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সাতকাণ্ড না করলে চলে না, বাড়াবাড়ি যত।

--"গুড। এবার তাহলে লুনাটিকের বাংলা বল। "


--"দ্যাখ দিদি, তোকে বলতে হবে না। উত্তর দিবি না বলে আমায় র‌্যাপিড ফায়ার করবি জানলে তোকে জিজ্ঞাসা করতাম না। লুনাটিক হলো তোর মতো লোকেরা বুঝলি? তুই, আস্ত পাগল। "


--"আজ লিভেট খাচ্ছিস। কাল ফিডিচ খাবো আমরা, ওকে? গ্লেন সেগমেন্টে খেতে হলে ফিডিচ বেস্ট। তোর গিফ্ট ধরে নে। না বুঝেই একদম ঠিকঠাক নিজের উত্তর নিজেই দিয়ে ফেলেছিস বলে পাবি। "


--"মানে? "


--" ইংরাজি, বাংলা, স্প্যনিশ, ফ্রেঞ্চ, এসব খোলস ছেড়ে বেরিয়ে একটু ভিতরে ঢোক শুভ। ভাষা, সে যেটাই হোক, প্রত্যেকের মোকাম এক। আত্তিকরণ বলে একটা শব্দ আছে কেন ভুলে যাস? ভাষার আত্মা যদি ছুঁতে পারিস কোনো মানুষেরই কখনো প্রয়োজন হবে না তোর ভাষা সংক্রান্ত কিছুর উত্তর পেতে। লুনা হলেন রোমান চন্দ্রদেবী। লুনার আর লুনাটিক দুটো শব্দই এসেছে লাতিন শব্দ এই 'লুনা' থেকেই। অক্সফোর্ড বলছে চন্দ্রাহত'রাই লুনাটিক। চাঁদের বিভিন্ন ও প্রতিটি দশার প্রভাব যাদের স্নায়ুতে অভ্রান্ত তরঙ্গ তোলে, ফলে তরল জ্যোৎস্নার মত দাহ্য অনুভূতিপ্রবণতা বহন করতে হয় জনমভোর, তাদেরই তোরা নাম দিস পাগল। মনস্তত্ত্ববিদরা বলেন যাদের বিশ্বাস একটি নির্দিষ্ট সত্যের বিন্দুতে এসে স্থির হয়ে গেছে, উন্মত্ত দ্রুততায় উদ্দেশ্য জেনে না জেনে ধাবমান সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে সমঝোতা করতে পারেনা যারা তাদের সেই বিশ্বাসের সত্য বা সত্যের বিশ্বাসকে, ভারসাম্য তারাই হারায় আর উপাধি পায় 'মানসিক ভারসাম্যহীন'। ভেবে দ্যাখ যে কোনো দিক আর সবদিক থেকে বিচারেই একমাত্র উন্মাদই সৎ কারণ সে যাকে সত্য বলে জানে তার উপরে বিশ্বাস হারাতে ব্যর্থ হয়। অথচ তার সত্যকে পাগলামি বলে দুনিয়া হাসাহাসি করে যেমন আমরা হাসলাম একটু আগে ইঁটের পাঁজাকে নিয়ে আমাদের অতীতের সত্যকে আগলে রেখেছে সন্তর্পণে বলে। 


গিরগিটি আত্মরক্ষার্থে যা করে, সফল মানুষ তা করে প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন সমারোহে তৃপ্তিসাধনের অজুহাতে। সফল ও সুস্থ কিছু হৃদিহীন দৈত্য মহা গৌরবে এগিয়ে নিয়ে চলে পচে গলে যাওয়া একটা সভ্যতার লাশ যেখানে সংবেদন শব্দ এক পাপ। এখানে কৃতী রিপোর্টার জোম্যাটোয় বিরিয়ানি অর্ডার করে এসি কিউবিকলে বসেন বন্যা পরবর্তী অনাহারে মৃত্যুর আবেগী খতিয়ান লিখতে আর প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর ঘড়ি দেখেন ডেলিভারি বয় দেরী করলে খিস্তি মেরে পেমেন্ট না দিয়ে ভাগাবেন বলে। এটা এমন সময় যেখানে প্রতিবন্ধী সংস্থা থেকে মাউন্টেন ট্রেকারের জন্য সংবর্ধনা প্রত্যাশিত থাকে। আত্মোন্মাদ পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ বিবরণ দেন বিলাস উদযাপনের, তাকিয়ে দেখেন না শ্রোতার সঙ্গে হুইলচেয়ার আছে কিনা। ব্যাক্তিগত উল্লাস, ব্যাক্তিগত অর্জনের যথার্থ সঙ্গত দাবী করা হয় উপেক্ষিত ও অক্ষম সত্ত্বাদের থেকে। এই নৃশংসতা আমায় শীতল করে ভয়ে। অথচ এদের মধ্যে সাধারণ অধিকাংশই নয়। মেধাবী, সৃষ্টিশীল বহু শুধু তাদের চৈতন্যে ধরা দেয়না যা আমি পাচ্ছি তার আনন্দ যে পায়নি সহস্র ইচ্ছেতেও, পাবেনা কখনো, তার থেকে চাই কী করে? সক্ষম মানুষের নির্লজ্জ প্রদর্শনী আমায় আতঙ্ক দেয়। শোন শুভ, আমি ঘৃণা পুষি সুস্থতার জন্য, বিতৃষ্ণা বরাদ্দ রাখি স্বাভাবিকতার জন্য। প্রতিটি সুস্থ সক্ষম সফল লোক এক একজন ধৃতরাষ্ট্র। 

আমার অহং আসে যখন আমায় কেউ উন্মাদ বলে সনাক্ত করে। আমি শান্তি পাই। বুঝি চাঁদ ছুঁলে কেন কেঁপে উঠি। "লোটাস ঈটার" পড়েছিস তো? নাহলে পড়ে নিস। "


--"দিদি, বড় অচেনা লাগছে তোকে, চুপ কর প্লিজ। "


--"ভয় পাচ্ছিস ভাই? চন্দ্রের সব কলঙ্ক প্রতিটি চন্দ্রাহত অভিশাপ নামে তাদের যাপনে বহন করে, চিনতে শেখ। গুরু পূর্ণিমায় জন্মালি তুই, যেদিন ইডেনে ভারত হিরো কাপ জিতলো, আর ক্ষত হলো আমার। এও কি সত্য নয়? "


গঙ্গা, অশ্বত্থ, প্রাচীন প্রাসাদ ভেসে যেতে লাগলো নিস্তব্ধতা আর জোনাক স্রোতে। শুভকে অদ্ভুত মনখারাপের রাগিণীরা ঘিরে ধরলো ক্রমে। কেন কথা বলতে বাধ্য করিয়ে কোনোদিন দিদিকে মাঝপথে না থামিয়ে সে পারলো না? যে সামনে বসে থাকলে তার মনে হয় আলো ঠিকরাচ্ছে, কেন তার অনায়াস অধিকারে থাকা প্রবল অন্ধকারের তল পেলো না? অথচ দুই ই সত্য। তাহলে কি প্রতিটি সত্য'ই তাই? হিরণ্ময় রহস্যাবৃত বহুমুখী এক কালখণ্ড মাত্র? 


অনুপম মুখোপাধ্যায়-এর আর্সেনিক আলোচনা করেছেন সোনালী চক্রবর্তী


 

হত্যার কবিতা
সোনালী চক্রবর্তী
________________
উচিৎ নয়, কখনো ব্যক্তির সঙ্গে টেক্সট, ঘটনার সঙ্গে বিষয় এসবের সম্পর্ককে টেনে আনা বা অস্বীকার কোনটাই হয়তো... নির্লিপ্ত হতে হয় অন্তত সাহিত্যে, সমালোচকের চশমায় চোখ যতই আপত্তি ওঠাক, কানের উপর প্রভুত্ব তারই অধিকারে। সেই কারণেই যে উপন্যাসের আনুষ্ঠানিক প্রকাশে আমি প্রশ্ন তুলেছিলাম কেন লেখকের তরফে সম্ভাব্য পাঠককে ভয় পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে তার পাঠ প্রতিক্রিয়ায় নিজের অবস্থানকে ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন করে যুক্তি দেওয়ার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু শেষ অবধি কী দাঁড়ায়? 'উচিৎ' বলে কোন শব্দের অস্তিত্ব কল্পনার জগতে অপ্রাসঙ্গিক, সৃষ্টির সাপেক্ষে অবৈধ।
"আর্সেনিক" পড়ে ওঠা কোন মানুষ যেমন কোনদিনই ক্ষমা করতে পারবেন না নিজেকে কেন তিনি কল্পনায় এত দুর্বল এটা ভাবতে বাধ্য হওয়ার জন্য। এই উপন্যাস এক কবির দীর্ঘ কবিতা এবং শিকার সফল তৃপ্ত পশু যেমন পূর্ণ তৃপ্তির অহং প্রকাশে কোন দ্বিধা রাখে না নায়ক অনুপমের মুখ দিয়ে লেখকও জড়তাহীন উচ্চারণ করেন- "আমি অনুপম মুখোপাধ্যায়। কোনো দেবদূতকে আমি কফি অফার করতে পারি। কোনো পরীর নিতম্বেও আমি চিমটি কেটে লাল করে দিতে পারি। কল্পনার এমনই চিরউজ্জ্বল অস্ত্র আমি শরীরে নিয়ে জন্মেছি, আমাকে হারানোর ক্ষমতা কারও নেই, কোনো ডাইনিরও না।"
আপাত অশুভ সব কটি মেটাফোর এই উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছে সে সাপ থেকে বিষ, অভিশাপ থেকে অন্ধকার যে কোন কিছুই এবং হয়তো সব কিছুই কারণ যেখান থেকে আমি দেখতে পাচ্ছি গাঁথুনি গথিক হোক বা আবহ আধ্যাত্মিক, "আর্সেনিক" মূলত হত্যার কবিতা, সে হত্যা প্রতিটি পাঠকের অন্তর্গত অবদমনকে, হিপোক্রিট সামাজিক ঘুণকে, প্রথাগত গল্প নির্মাণকে এবং প্রকৃত মূল্যায়ন দিতে অক্ষম বাঙালি পাঠকের রুচি, সবকিছুকেই।
হ্যাঁ আমি প্রশ্ন ফিরিয়ে নিচ্ছি, এই উপন্যাস পড়তে গেলে ভয় পাওয়া উচিৎ কারণ যে কেউই এটি পড়ে ফেলতে পারবেন কিন্তু ধারণ করতে পারবেন না। এই বিষ হজম করে ঢেঁকুর তোলা অসম্ভব, এই লেখক নৃশংস। যদি যৌনতার খোঁজে পড়তে চান, অবশ্যই পড়বেন কিন্তু মনে রাখবেন কিছু শীৎকার মৃত্যুরও হয়, প্রেম ও সম্পর্কের দ্বন্দ্ব চিনতে চাইলেও পড়তে পারেন কিন্তু তারপর বেশ অস্বস্তিতে পড়বেন আয়নার সামনে দাঁড়ালে।
"আর্সেনিক" খুব বড় একটা আঘাত। লাতিন সাহিত্যের মত তীব্র স্বাদে অভ্যস্ত পাঠকও শূন্য হয়ে যায় যা পড়ে ওঠার পর, নগ্ন একটা হাহাকার, আর লেখক জিতে যান। পৈশাচিক একটা হাসি ভেসে আসে। অনুপম, এভাবেও কি প্রতিশোধ নিতে আছে?
____________________________
____________________________

সোনালী চক্রবর্তীর জন্মদিনে আলী আফজল খান


 
শুভ জন্মদিন সোনালী:
তীর্থের কাকের কেন অপেক্ষার জন্য খ্যাতি আমি আজও বুঝি না, ব্যাটা অপেক্ষা কি জানে নাকি? কিছু প্রিয় মানুষের সাথে তবু দেখা হয়ে গেছে করোনার সময়ে ভার্চুয়ালি, বাঙালী নব বিবাহিত দম্পতির আয়না দেখার মতো। বাস্তবে সোনালীর সাথে দেখা হয় নাই আমার, আয়নায় দেখা হয়েছে ভিন্নচোখের লাইভ করার সময়, নিচের ছবিটা ব্যাকস্টেজে সেই সময়ই ধরে রাখা, জন্মদিনে উইস করার জন্যই ফ্রেমটা রেখে দিয়েছিলাম।
জন্মদিনে তোমার জন্য একটা নতুন লেখা উপহার পাঠালাম সোনাই, ভালবাসা আর শুভ কামনা অনেক অনেক, ভাল থেকো খুব।
আয়নামহল।।
আলী, কয়েকটা গাঁট কিছুতেই ভাঙছে না
: দেখো, তুমি মারা যাবার পর আমি একটা ব্ল্যাকহোলের মতো আবর্তে পড়ে গিয়েছিলাম....তারপর একের পর এক ঝড়
: একটা সময় জীবন থেকে পিছিয়ে পিছিয়ে শয্যাশায়ী, নির্ঘুম, ট্রমায় ছিলাম কয়েক বছর....
: এখনও কাউন্সিলিং করাই, রেগুলার করাতে বলে, হয় না...কিন্তু মেডিক্যাল ওয়াচে থাকি
: এসব নিয়ে কাউকে বলি না। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলে কখনও তোমাকে বলব
: কিন্তু এখন বলা মানে নিজের ওপর ঝড়কে আবাহন করা
: যে জায়গায় পৌঁছেছিলাম,জীবনের মূলস্রোতে ফিরে পড়াশোনা চাকরি এসব করতে পারব বলে আমার ডাক্তাররাও আশা রাখেননি
: এই সময়টা আমার ভেতরে বহু কিছু ভেঙে দিয়েছে,তছনছ করে দিয়েছে।
: কয়েক বছর,কোন বই পড়িনি, সিনেমা দেখিনি, গান শুনিনি, নতুন কিছু শিখিনি
: নিজের সমস্ত ক্ষমতায় মরচে পড়ে গেছে। নষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কোনক্রমে কিছু মেধা বেঁচে গিয়েছে
: অব্যবহার আর ধ্বংসের চরম
: ফোকাস অসম্ভব রকম সরে গিয়েছে। বই পড়তে পারি না আলী, কোন বই
: কেউ টাস্কের মতো করে পড়তে দিলে ঝড়ের বেগে চোখ বুলিয়ে দিই
: আত্মস্থ করার যে কোন পদ্ধতিকে ভয় করে
: ছবি আঁকা শিখতে পারি না, আঁকতে পারি না....ভয়ে পিছোই
: লিখতে গেলে লেখাটাকে দূরে ঠেলতে থাকি
: সমস্ত কিছু থেকে ভয়াবহভাবে পালাই। লঘু তরল জিনিসপত্রে নিজেকে ভুলিয়ে রাখি, রাত্রে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই
: অর্থবহ সব কিছুকে ভয় হয়
: কুরে কুরে খায়, এই জীবনে না থাকাটা
: কিন্তু এভাবে বাঁচা, না বাঁচার সামিল। গোটা একটা জীবন এই শামুকের মতো বেঁচেছি। এবার দরকার হলে নিজেকে আছড়ে ভেঙে সত্যিকারের বাঁচতে হবে
: সেই এক প্রসেস, ভাঙবার, ব্যর্থ হবার....এক, এক, এক
: আমার বাবা মানসিকভাবে সুস্থ নেই...ওনার চাকরিও বেশিদিন নেই। আমার মার বড়ো সাধ আমাকে কৃতী দেখার
: উনারা আর কবছর বাঁচবেন?
: আমার বাবার কোন সঞ্চয় নেই, আজীবন সব জলের মতো গেছে। স্থাবর অস্থাবর কিচ্ছু না। কারো শরীর খারাপ হলে তাকে যুঝবার মতো বল নেই আর্থিক।
: যা করতে হবে আমাকে.....মা-বাবার স্বাস্থ্যের জন্য ব্যাক আপ, বাড়িঘর বানানো, ভাইকে পড়ানো। সব
: বাবাকে সুখী দেখতে চাই, নির্ভারও
: আর সাতদিন আছে পরীক্ষার। আমি জানি আমি অক্ষরও পড়িনি।
বড় চাচা বহুদিন চুপ আছে, এই পরীক্ষাটার জন্য অপেক্ষা করছে। তারপর ফের বিয়ের কথা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে
: বাবা সক্ষম না, চাচু হাত ঝেড়ে ফেলতে চায়
: আমার দাদুর প্রাণ ছিলাম আমি। দাদু চাইতেন লেখাপড়ায় আমি যাতে সবার আগে থাকি। ছিলামও, উনি যতদিন বেঁচে ছিলেন। আম্মা এখনও বলেন, যে সক্ষম থাকতে থাকতে আমাকে আমার জায়গায় দেখতে চান
: চাচার সমস্ত ব্রেনওয়াশ সত্ত্বেও, উনি এখনও চান আমি পড়াশোনায় দারুণ কোন উচ্চতায় পৌঁছাই
: আলী, ম্যাক্সিমাম লড়াই করে আর এক বছর সময় পাব আমি।
: তার মধ্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার রাস্তায় এনে ফেলতে হবে। লড়াইয়ের স্পিরিট আর নিজের প্রতি নিজের সম্মান ততদিনে ফেরত পেয়ে যাব আমি। তারপরে যেমন আসবে জীবন, লড়ে নেব
: এই জার্নিটা শুরু করতে, লড়তে আর জিততে চাই আলী
: তোমাকে ছাড়া কাউকে জানাইনি...তোমাকে না বলে হতও না আমার
: সামনের সদ্য পরীক্ষাটা শেষ হলে আমি একটা ব্রেক নিয়ে ঘুরতে চাই। বেড়াতে, নিজেকে এক্সপ্লোর করে ফ্রি এয়ার দিতে
: একমাত্র বেড়ালে আমার মাথার বন্ধ কবাট খোলে,নিজের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে পারি
: অন্য সময় নিজের শত্রু হয়ে বসে থাকি
: এই ব্রেকটার পর, পড়াশোনা শুরু, মস্তিষ্কের ধার বাড়ানো... অধ্যবসায় relearn করতে চাই। ভেতরের সমস্ত ভয় তাড়াতে। নতুন প্রজেক্ট শুরু করতে চাই, নতুন কাজের টার্গেট নিয়ে সেগুলো শেষ করা
: নিজের স্কিল বাড়ানো। আর রোজ পড়াশোনা
: এবার পড়াশোনার জন্য একটা খরচ থাকবে, রেজিস্ট্রেশনের। বেড়ানোর, প্রজেক্টের।
: আলী, প্লিজ সঙ্গে থাকো।

সোনালী চক্রবর্তী সম্পর্কে বিদিশা সরকার


 
ভৈরবীর দিনমান
--------------------
সোনালীকে আমি এইভাবেই পড়ি। সোনালীর সমগ্র। সোনালীর মার্গ দর্শন। যখন নিজেই নিজের কবিতা সম্পর্কে কবিতা বেশাতি এ কথাই বলেছিলাম। তখন মমিস্রোতে সেই বেহায়া নাম্নী যদি তার দগ্ধ দাগগুলো দশাশ্বমেধে রূদ্র রূপ নিয়ে জিভের মানুষটিকে উদ্দেশ্য করে কিছুটা উচ্চকিত হয়ে বলে "ভাদ্রমাসে দেখেছি পেখমরাত জুড়ে তুলো - তুলো সন্ত্রাসবাদ ...."
অথবা " ছায়াপথ পোড়া ছাই উড়ে এসে বৃষ্টি নামালে তোমাকেও কি বলা যায়,শঙ্খ পায় সখা,পাখি সুখ না ছড়ালে পরাগও বিষই লাগে"।একে কখনো আক্ষেপানুরাগ বলা যায় না।তিতীক্ষার সুপ্ত আস্ফালনও নয়। পাত্র থেকে উপচে পড়া অমৃতের অপচয় ও বিষোদগার ‌। জানি না ক'জন ভৈরবীর কান্না শুনেছেন বা শোনার প্রয়োজন বোধ করেছেন।বস্তুবাদীদের কাছে ভোগ্য সীমাবদ্ধ সময়ের পর উচ্ছিষ্ট ছাড়া কিছুই নয়। আমার পরের কবিতায় পৌঁছতে সময় লাগে।ভাবি কি ভাবে শুকিয়ে যায় চোখের জল। আবার নতুন আয়োজনের প্রস্তুতি পর্বে সেই অনিবার্য সত্যি কথাটা বলবে বলেই এই পূর্ব প্রস্তুতি। "অথচ বিষাদনামায় দাসখত লিখেও/ কেউ বুঝল না আজও ,/ কোন যাতনায় তার শরীরে রোহিণীর সওগাত রাইয়েরই নীলাম্বরী।"
আমি কবি সোনালী চক্রবর্তী'র "মমিস্রোতে বেহায়া সিন্থ"এর কথা বলছিলাম। আভোগি উত্তাপ বিষয়ক কিছু আশ্লেষ তারাণা'র অন্তে অর্গাজমের ঠিক আগের মূহূর্তে ছিঁড়ে যাওয়া বেহালার ছর ও পর্দার অন্তরালের অযাচিত অবারন বৃষ্টির শীর্ণ প্রগলভ ধারা যেন প্রোযেক্টরে ভেসে উঠছে আর আমারই পরণের শাড়িটা সেই ছায়াছবিতে ছুঁড়ে দিয়ে বলছি ' বসন পরো মা ......।
এই বই বিষয়ে এর বেশি একটা কথা আমি বলতে পারব না। বইয়ের একটা কবিতা দিয়ে শেষ করব।
পাখি, ঘুড়ি আর সুতো - সুতো মানুষ
-------------------
একটা মেয়ে ভালোবাসলে পাড়ে বসে আয়ু ফুরিয়ে দেয়।যার নাম কুবের সে ঘরের দায়ে রোজ জাল ফেলে। নিজেকে পাখি জেনে বেচবে বলে কোনো-কোনো পাগল বাজারে পৌঁছে দেখে হাজার হাজার মৃত চাঁদ আঁশটে জলে ঢুবে খাবি খায়।ঘুরিটা উড়তে উড়তে ভাবে, আহা,কী সরল মাটির গান,বঁটি দিয়ে কিছু জ্যোৎস্না কুচিয়ে দেওয়া গেলে তিনটে মানুষেরই অন্ধকার নেভানো যায়।

Friday, September 24, 2021

প্রার্থনা : হে ত্রিপুরেশ্বরী


 

কবিতা : মঞ্জিরা

 

 
মঞ্জিরা 



বন্দিশেরা নামছে সহস্রধারায় কৃষ্ণ অন্তরীক্ষ থেকে। নীলাদ্রি শুনছেন। বলা ভালো, শুষছেন। এই একটিই প্রেম তাকে কখনো গার্হস্থ্য চাওয়া পাওয়ার সরলবৃত্তে প্রবেশাধিকার দিলো না। উস্তাদ আমির খান যখন বিলাসখানি টোড়িতে "বাজে নিকি ঘুংঘরিয়া" ধরেন, ধর্মাচরন থেকে বহুদূরে থাকা নীলাদ্রির জগত, বৃন্দাবন হয়ে যায়। তিনি স্পষ্ট দেখতে পান খান সাহেব "রহিয়ে অব এয়সি জাগা" গাওয়ার সময় গজলের শেষ মীরটি শুনতে স্বয়ং গালিব এসে দাঁড়ান তার পানপাত্র ফেলে রেখে। অশ্রুই তো সেই নিরপেক্ষ বহতা যা যে কোন স্থান কাল পাত্রকে নিমেষে অপ্রাঙ্গিক করে দিতে পারে অপ্রতিরোধ্য তাড়নায়।
 

নীলাদ্রির বিশ্বাস মানুষ তার মানবিক পৃথিবীতে যাবতীয় বিগ্রহ এবং ধর্মের রূপকল্প নির্মাণ করেছে সঙ্গীতের স্বার্থে। একমাত্র সুরই সেই অতীন্দ্রিয় শক্তি যা শরীরে অবস্থান করেও আত্মাকে ত্রিলোকের উপলব্ধি দিতে পারে যদি আদৌ অদ্বৈতের অস্তিত্ব থাকে। শ্যামসুন্দর তার কাছে নজরুলের কৃষ্ণসঙ্গীতের বাইরে কিছুই নয়। তিনি হরিকে জানতে ব্যগ্র হননি শুধু "সে হরি কেমন বল" শুনে ভেসে গেছেন। তার হরি ঐ সৃষ্টিজারিত তুমুল আবেগটিই, কোনো আধার নয়। 


সময় কী কখনো ভাবার মতো সময়ের সন্ধান নীলাদ্রি করেন নি। ওয়ার্কহোলিক নয়, কর্মযোগও নয়, গণিত আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, এই দুই গহীন তাকে এতোটাই দুর্গম করে রেখে দিলো এত বয়স অবধি যে, সেই অরণ্যে তার নিবিড়ে বসা পাখিরা কতটা অভিমান জমিয়ে মেঘ হয়ে উড়ে গেলো, জানতে পারলেন না। কী বিচিত্র দ্বন্দ্ব আকীর্ণ সংবেদন। গওহরজানের ঠুংরির একটা মুড়কি যাকে তোলপাড় করে দেয়, বড়ে গুলাম আলীর "প্রেম যোগন বনকে" যাকে প্রেমিক করে তোলে লাজিজ মরহুমে, তিনি একবার তাকিয়েও দেখলেন না এতগুলো বছর ধরে দাবানল খুঁজে না পেয়ে পাথর হয়ে যাওয়া বৃক্ষবিষাদের শরমকে। অজস্র সূঁচ বিঁধে থাকা চামড়ার ব্যথাবোধ শরীর হারালে সম্ভবত মেধাবী মস্তিষ্ক অধিক সক্রিয় হয়ে ওঠে অচেতনে। হয়তো তাই আখতারী বাঈ- এর একটি আলাপ মনে পড়ছে তার অতিরিক্ত, ঘুরে ফিরে, "ইয়ে না থি হামারি কিসমত" ।

এও এক বিস্ময় স্বধার কাছে। সারা জীবনে হারমোনিয়াম, তানপুরা অথবা তবলার মতো নিরীহ, সহজপাচ্য বস্তুগুলি, বাঙালী সংসারে বাসনপত্রের মতোই যাদের উপস্থিতি ছিলো অন্তত কুড়ি পঁচিশ বছর আগেও, কোনোদিন ছুঁয়ে দেখেন নি নীলাদ্রি অথচ এক পলের অধিক সময় তিনি কখনো নেন নি খমক আর একতারার পার্থক্য বলে দিতে। তড়পেছেন সঙ্গোপনে যখন মিউজিক ট্যালেন্ট হান্টে অংশগ্রহণকারী কোনো শিশু তার কাছে বলতে পারেনি সেতারে ১৭ টি তার থাকলেও সুর নিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকে মাত্র তিনটিতে, বাকিগুলি 'তরপ'। নীলাদ্রির চরম শত্রুরাও তাকে প্রজন্মবিরোধী দলের শরিক এই অপবাদ দিতে পারবে না কিন্তু স্বধা তার উপর ক্রমবর্ধমান হতাশার ছায়ার অধিগ্রহণ দেখেছে নিয়ত যখন হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, শিবকুমার শর্মা, উস্তাদ নিশাত খান, পাঁচুগোপাল দত্ত, শুভলক্ষ্মী, অন্নপূর্ণার মতো ব্যক্তিত্বরা নিছক কতগুলো নাম হয়ে বন্দিত্ব নিয়েছে কম্পিটিটিভ এক্সাম প্রার্থীদের বৃত্তে।


এক ফাল্গুনী সন্ধ্যা তিনি উপহার দিয়েছিলেন স্বধাকে। সে তখন এক কলিগের বিয়েতে না গিয়ে উপায় নেই বলে তৈরী হয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলো বাবার স্টাডিতে। নীলাদ্রি শুরু করেছিলেন "ফ্রী স্পিরিট" দিয়ে।

--"এসো, এসো, না হয় দেরীই হবে খানিক"


তারা পৌঁছেছিলো তারপর "ঘাট অব বেনারস" এ।

--"তুমি বিয়েবাড়ি যাচ্ছিলে না?
    অ্যারেঞ্জ না লাভ?
    বেশ, এই দুটো পরপর শোনো             তাহলে,
     "বিলাভেড কল" আর
     "মিসিং অব হার্ট"


ফল্গুর উচ্ছ্বাস স্মরণ করিয়ে স্বধাকে যখন শেষে শুনিয়েছিলেন নীলাদ্রি "হোলি ম্যাট্রিমনি", স্বধার জানা হয়ে গিয়েছিলো ভালোবাসা আর বিবাহের সংজ্ঞা শিখিয়ে দিতে একা বিসমিল্লা জন্ম জন্মান্তরের দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন। বিয়েবাড়ি আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কী প্রয়োজন লোকসমাগমের? তার তো অভিসার অধিগত হয়ে গেছে সদ্য, সিঁদুরের রঙও মাখা শেষ। 


--"তোমার আনুষ্ঠানিক সম্প্রদান আমি করবো না কখনো। সেই অধিকার আমার নেই। কোনো নারীকেই দানের অধিকার কোনো পুরুষের থাকে না আরেক পুরুষের হাতে। স্বধা, আমি ব্রাহ্মণ যে। ব্রহ্মজ্ঞান না হোক, আত্মার বর্ণকে অশুক্ল করি কী ভাবে? তুমি আমার অংশবীজ। গ্রহন বা অর্পণের দায় মানুষের হাতে থাকে কি? যোগসূত্রকে অস্বীকার করে, অজ্ঞাত যেমত, অনুষ্কাকে শুনো, নোরাকেও। পন্ডিতজীর অবয়ব ভাসবে না? দ্যুতির আহুতিতে অঙ্গুলিত্রাণ জরুরী, শিরস্ত্রাণ নয় "


বহুবার জানতে চেয়েছে স্বধা, নীলাদ্রি উত্তর দেন নি। আজ মনে হলো বড় দেরী হয়ে গেছে। হয়তো জানিয়ে দিলেই পারতেন। হিন্দুস্থানী মার্গসঙ্গীতের একনিষ্ঠ শ্রোতা কিন্তু অভিনিবেশে স্পষ্ট হয় নীলাদ্রির ঝোঁক আবদুল করিম আর ফায়েজ খানের গমকে যতটা, তার থেকে অনেক বেশী তাদের গোবিন্দ বন্দনায়। কেন? নীলাদ্রি মনে মনে উচ্চারণ করলেন, জানেন স্বধা বুঝে নেবে একদিন ঠিক। ঈশ্বরের অর্থ যদি নিখাদ ব্রহ্ম হয় তাহলে নীলাদ্রি তীব্র আশ্বাস রাখেন সেই সমস্ত সুরসাধকদের গায়কীতেই অধিক যারা ধর্মকে শুধুমাত্র একটি শব্দে পরিণত করতে পেরেছেন। অতিক্রম করে গেছেন লোকায়ত ও প্রচলিত ধারণা ও আচরণ। পৌঁছে গেছেন অনাদির সেই অভেদ অবস্থানে যেখানে রসুলের সর্বনাম সরস্বতী। 


মাঝে মাঝে স্বধার মনে হয় চেতন অবচেতন থেকে ক্রমশ অচেতনের দিকে সরে যাওয়া তার বাবার এই পরিণতি হয়তো সিদ্ধান্ত মাত্র। এই মুহূর্তে যে রাষ্ট্রে তাকে শ্বাস নিতে হচ্ছে তা তার অপরিচিত ও অসূয়ার কারণ। তিনি প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন নিজেকে ক্রমেই। যেভাবে মুছে ফেলা হচ্ছে নগরীদের নাম, হয়তো তার প্রাণপ্রিয় ঘরাণাদেরও বদলে ফেলা হবে তাদের স্রষ্টাদের ধর্মবিচার করে। জয়পুর আত্রাউলি, পাতিয়ালা, রামপুর মহাস্বন, ইন্দোর, কিরাণা, আগ্রা, গোয়ালিয়র, দিল্লী, ভেন্ডিবাজার, মেওয়াটি, শ্যাম চৌরাশিয়া- সবকটি এবং প্রতিটিরই প্রতিষ্ঠাতা প্রো-হিন্দুত্ব সাম্রাজ্যবাদীর ষণ্ড দৃষ্টিতে অপরাধী, যেহেতু বিধর্মী। সেই নরকজল বাইতে পারবেন না, এই আতঙ্কেই কি যাবতীয় চিকিৎসাকে প্রার্থিত ফলপ্রসব করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন তিনি নিজেই?

বহুর মধ্যে বিশেষ করে একটি বিতর্ক বাকী থেকে গেছে স্বধা ও নীলাদ্রির। কেন এক জমিনে দুজনেই বিচরণ করেও তারা, পিতা ও কন্যা, মূল আদর্শগত কেন্দ্রে এতো বিরোধী। তাদের ফোর্ট এক নয়, আঙ্গিকও নয়। সেই কারণেই কি? নীলাদ্রি মানুষ থেকে ক্রমে দূরত্বে গেছেন যে পন্থায় ঠিক সেই প্রকরণে কেন স্বধা মানুষেরই মধ্যে খুঁজে ফিরছে পরশপাথর? পৃথিবীর যে তিনটি জায়গায় তাদের যাওয়ার কথা ছিলো অবরোধ উঠলেই, তাদের মধ্যে এই মুহূর্তেই তার পৌঁছে যেতে ইচ্ছে করছে সিস্টিন চ্যাপেলে। নীলাদ্রি বারবার শেখাতেন স্বধাকে শিল্পীর জীবন নিয়ে না ভাবতে। শিল্পই শিল্পীর সাক্ষর। যন্ত্রণা, অর্জন ও প্রাপ্তি-প্রাকাম্যের। সৃষ্টি ও স্রষ্টা একীভূত। যখন নীলাদ্রির ডোবার কথা ছিলো "ও গ্রেসিয়াস লাইট" অথবা অন্যান্য ভেসপারের অতলে পিয়ানোয় চোখ রেখে, স্বধা দেখে বেড়াতো ফ্রেস্কো, এঞ্জেলোর মায়া ধার করে। এর কারণ কী? নিজেকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে সামান্য কাঁপলো সে। তাহলে কি ব্যবধান রেখার কাছাকাছি পৌঁছাতে চাইছে সে ক্রুশ আর ক্রাইস্টের? ছুঁয়ে দেখতে চাইছে ইন্দ্রিয় সম্বল করে ফ্যান্টাসি আর স্পর্শযোগ্যতার লাইন অব কন্ট্রোল? বাবাকে বলা হলো না। আর কখনো সুযোগ আসবে কি?


ভোর হয়ে আসছে। ইডেনের কেবিন ওয়ানে ধ্রুপদে ভৈরবী ধরলেন আল্লাদিয়া খান। কে বলে 'হংসধ্বনি' রাগ মাত্র? কে বলে শুধু 'মিঞা কি মল্লার' পাবক শান্ত করে? অসংখ্য ভেজা ভেজা সাদা ডানা উড়ে যাচ্ছে কাদের তাহলে কাচ পেরিয়ে দিগন্তের দিকে? স্বধা দেখছে। অক্সিমিটারের নেমে যাওয়া কাঁটা তাকে বাধ্য করছে ডক্টর সেনকে ফোন করতে অথচ টের পাচ্ছে এ অন্যায়। যাত্রাপথে বাধা হতে নেই। হটাত তার সমস্ত কোষে জিহাদ জ্বলে উঠলো নৃশংস মাত্রায়। কেন প্রতিবার নির্লিপ্তিতে নীলাদ্রি পেরিয়ে যাবেন প্রতিটি সম্ভাব্য সংঘাত? অসীম নিস্তব্ধতা দিয়ে এড়িয়ে যাবেন অনিবার্য প্রতিরোধ? আজ তাকে ফিরতেই হবে। নাড়া স্বধার হাতেও বাঁধা হয়েছিল তিন বছর বয়সে ইলাহাবাদে। সে অন্য ইতিহাস। ইনশাল্লাহ, আজ সে হারবে না তার পঞ্চগুরুর প্রথম জনের কাছে।



কবিতা : পরাগ

 

সোনালী চক্রবর্তী

                                       


পরাগ 




মৎস্যকন্যার হিজাবের নিচে প্রেতমুখের অতিরিক্ত কিছু ছিলো না- এই সিদ্ধান্ত স্বধার মস্তিস্ক নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোর গতিবেগের লাজ রাখতে আধা পাথুরে প্রায় জোলো উপত্যকার প্রতিটি বৃক্ষ ফিসফিসিয়ে উঠলো- আদেশ ... আদেশ...


যে তাকে প্রথম জানিয়েছিলো এই প্রদেশের কথা, তার কথা স্বধার সম্যক মনে আছে। সে কৃতজ্ঞতা ধারণ করে পর্যাপ্ত কিন্তু সিসিফাসের স্ত্রী লিঙ্গের ভূমিকায় নিজেকে মনোনীত করার বিন্দুমাত্র স্পৃহা নেই বলে ছাই আর আঁশবটি- দুইকেই অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে। 'সংসার' আর 'সম্পর্ক' এই দুই সংগ্রামে 'সার' ঠিক ততোটুকু যতখানি পরমহংস বৃত্তি, বাকিটা 'সংনামা'। হা হা করে হেসে উঠলো সে। প্রতিধ্বনি এলো না কারণ শুধুমাত্র তার কাছেই, তার জন্যেই আসা ক্ষতখচিত পাঁজরকে প্রকৃতি যখন আশ্রয় দেয়, মানুষের মতো লবণ লীলা করে না। 



বড় আশ্চর্য রূপ এই ময়ূর পাহাড়ের। সে বর্ষায় এসেছে, চ্যাপলিন মনে পড়েনি। পদ্মবিল দেখার সময় শ্যাম-নৌকা ভেসেছে। তার কিছু ব্যাক্তিগত রূপকল্প আছে যেগুলো ঘুমিয়ে থাকে অন্যসময় কিন্তু রিপ ভ্যান হতে পারে না। যখন একটিও দূর্বা পা ছুঁয়ে বলে ওঠে লেলিহা মুদ্রায় "অস্যৈ প্রাণা: প্রতিষ্ঠন্তু অস্যৈ প্রাণা: ক্ষরন্তু চ", মুহূর্তে চরাচর তার কবিতা বোধ হয়- 'অবাঙমানসগোচরম' ।


স্বধার মনে পড়তে থাকে শৈবলিনীর কথা। এই একজনই এখনো অবধি জীবিত অথবা একমাত্র প্রাণ যে তাকে 'স্বাধীনতা' শব্দের সংজ্ঞায় কোনো সৌজন্যসূচক ঝরোখা রাখতে শেখায়নি। একবার, মাত্র একবারই তিনি বেনারসে পা রেখেছিলেন তার বন্ধুর ডাক ফেরাতে না পেরে। সেইবার জন্মইস্তক স্বীয় করতলের মতো চেনা বেনারসকে স্বধার অপরিচিত লেগেছিলো বিস্ময়ে। এমনকী, সে যার পৌত্রী, তারও। কে না জানে (অন্তত তখনো অব্দি অবশ্যই জানত) লক্ষ্ণৌ-বেনারসে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঈজীদের মহল্লা। সময় শুধু স্থাপত্য গুঁড়িয়ে দেয় না, লঘু করে তোলে গভীরতা। নাহলে জ্ঞান, নৈপুণ্য, শিক্ষা, তালিম, নিষ্ঠা সমস্ত কিছু নিংড়ে যে অসামান্য শিল্পীদের নির্মাণ করা হতো অভিজাত হাভেলি গুলিতে, তাদের পরিচয় ধীরে 'তবায়েফ', আরও হীনতায় 'দেহপসারিণী' হয়ে যাবে কেন? শৈবলিনীর সঙ্গে তারা দুইজন ঘুরে বেড়াতো ভোরের আলো ঠিকঠাক ফুটে ওঠার আগে। একমাত্র এইসময়েই এই এলাকা নিস্তব্ধ থাকে। বাসিন্দারা হয় নিদ্রিত নাহয় ঘাটে। শৈবলিনী কথা বলতেন বৃদ্ধা কাউকে পেলে, আনমনে সিঁড়িতে বসা, অতীতের ফুলকারিটি গায়ে জড়িয়ে। জানতে চাইতেন ইতিহাস। বাড়ি ফিরে স্তব্ধ হয়ে থাকতেন। সন্ধ্যায় গঙ্গারতি দেখতে দেখতে উদাস হয়ে যেতেন। পরে, বহু পরে স্বধাকে বলেছিলেন-


--" আগুনের দুর্ভাগ্য অসীম না ভাই যদি ভাগ্য মানি? যত তীব্র তত উজ্জ্বলতা। যারা জ্বালায় কেউ জ্বলে না। কেউ উত্তাপ নেয়, কেউ আলো, কেউ পবিত্র হয়, কেউ শুদ্ধ, কেউ মুক্তি নেয়, কেউ শান্তি। সরে যায়। আগুন নিজে কী পায়, কাকে পায় বলতে পারো? আগুন একা, শুরু থেকে শেষ। তবু যদি তার স্বাধীনতা টুকুও থাকত। সে কি নিজের ইচ্ছেয় জ্বলে? কেউ দাবী তোলে শিখায় আদরের আঙ্গুল রেখে, অস্বীকার করো দাহ্যকে? আগুনের কি ব্যথা নেই? ভাই, বড়ো মিল, বড়ো মিল, প্রতিটি নারীই কি আগুনপাখি?"


গতরাতে দাবানলের খবর পেয়ে পৌঁছানো স্বধার অযোধ্যার দিকে তাকিয়ে খেয়াল হলো, তার কখনো তমাল দেখা হয়নি। এতো এতো অরণ্যে ঘুরেছে সে, এই মুহূর্তেও তো হাঁটছেই, তবুও হয়নি কখনো। অথবা এও হতে পারে, চেনেনা বলে অধরা রয়ে গেছে। শৈবলিনী বলতেন সপ্তপর্ণার কথা। তাও দেখা হয়নি। আবারও হাসতে ইচ্ছে হলো তার। বহু আগে লিখেছিলো- পালক খেললে ময়ূর তুমি, কৃষ্ণ জানলে না। তার শুধু খুঁজে বেড়ানোই হলো। জল কি কখনো ভেজে?


স্বধা গবেষণার জন্য প্রথম বেছেছিলো একটি অদ্ভুত বিষয়- 'ধর্মরূপ ও উত্তরসত্য' । যেভাবে একটি নদীখাতের উৎস থেকে মোহনা অবধি উপ আর শাখাতে বিভাজিত ও যুক্ত হতে হতে অস্তিত্বহীন হয়ে ওঠে মূলধারাটি, তেমনই তো যে কোনো মিথ, মিথ্যের সিনোনিম। কিন্তু বিশ্বাসকে ডিগ্রিতে রূপান্তরিত করতে যে তথ্য ও যুক্তির নিপুণ কৌশল লাগে, তা করায়ত্ত না হওয়ায় অসম্পূর্ণ থেকে গেছে অন্বেষণ। একটিমাত্র উদাহরণ দেওয়া যাক? কীভাবে সে উপড়ে দেবে কোটি কোটি চার্চ থেকে অদ্ভুত সুদর্শন ক্রাইস্টের রেপ্লিকা? মুভমেন্ট করবে? রক্তে গেঁথে যাওয়া বিশ্বাসের কী হবে? আরবীতে যে স্থানের নাম 'মাংসের বাড়ি', হিব্রুতে 'রুটির ঘর', সেই বেথলেহেম শহরের ভৌগোলিক অবস্থান বিচার করলে কী দাঁড়ায়? ভূ-মধ্যসাগরীয় উপকূল- ইজরায়েল- ঈজিপ্ট- জর্ডন-  এই তো? ন্যূনতম চিন্তা করলে যে কোনো মানুষের কাছে স্পষ্ট হওয়ার কথা এই অঞ্চলে জন্মানো কারোর সোনালি চুল হয় না, বরফশুভ্র ত্বকও নয়। সুন্দরীশ্রেষ্ঠা ক্লিওপেট্রাও তা ছিলেন না। অথচ, ক্রাইস্টকে স্মরণ করলেই যে আদল মাথায় ভেসে আসে সে পেন্টিং আর ভাস্কর্যের সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ মডেল। স্বধারও তাই ই আসে। কেন অস্বীকার করবে? সত্য সম্ভবত তা নয়। জন্ম, নাসা, কাঁটা, ক্রুশ সমস্ত কিছুই এক মানবসন্তানকে অলৌকিক করে তোলার অনুপান মাত্র। 


মানুষ তার শরীরে মানুষ খোঁজে, মাথা নিচু করতে আর হৃদয়ে বসাতে চায় অতিমানুষ। "ম্যান" তার কাছে প্রশংসার শব্দ, ফ্যান্টাসিতে রাজ করে সুপারম্যান'ই। স্বধা অপেক্ষা করে থাকত কখন অরণ্যদেব মুখোশ খুলে নার্দার সঙ্গে দেখা করবে, ব্যাটম্যান কখন ক্যাটউমেনকে ভেবে মুখ গুঁজবে জাল ছিঁড়ে। উলটে যেতো পরপর পাতা। তার ভীষণ মনে হতো এই সব চরিত্র আসলে নিখুঁত উদাহরণ মানুষ আর ঈশ্বরের শতরঞ্জের। মায়ামুখোশ টুকুই আড়াল মাঝের ঝিল্লির। কখনো কখনো স্ট্রিপ শেষ হয়ে যেতো, পর্দাটা উঠতো না। প্রতিটা যাপন সম্ভবত এই উৎকণ্ঠার নাম। বিরাট হাঙর। ধরতেই হবে। জয় আসে। অথচ উপভোগ্য স্তর পাড়ে টেনে আনতে আনতে সে কঙ্কাল। "রাইডারস টু দ্যা সি"- এর মতো করে জীবন চেনাতে কেই ই বা পারলো আর। স্বধা কিছুটা পার্সোন্যালাইজড করে নিয়েছে এর ব্যাখ্যা। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা- নারী মাত্রেই জানে লিঙ্গ সাম্রাজ্যবাদের বানান ঠিক কী। পূর্বরাগে প্রেমিকেরা উত্তাল, কেন না মায়াঅন্ধত্বে তাদের ভিতর বসত গড়ে ঈশ্বরসত্ত্বা, শোনপুর মেলার বিক্রির আগের চোখ সেলাই করা বাজপাখি। সময় পেরোলে হাতে থাকে শুধু করোটির পানপাত্রটি। আজ প্রচন্ড হাসি আসছে স্বধার, প্রেতের হাসি-

-- শৈবলিনী, সত্য তুমিই ছিলে। আগুনের ব্যথা হতে নেই। জলের ভিজতে নেই। যে ঈশ্বরীয় রূপ মানুষের ফ্যান্টাসি, তার মুখোশও নামিয়ে নিতে নেই।

ঘোর আঁধারে কোথাও তক্ষক ডাকছে। স্বধা চিনতে পারে যেমত সে সর্পযোনি। আজ নগ্নিকা তার এই অরণ্যে চন্দ্রপানের তিথি, ইস্তার জন্মের দায়...

কবিতা : মহাফেজ

 


মহাফেজ
'অনুভূতির অনুবাদ সম্ভব নয় বলে কখনো কবিতা পড়িনি'- প্রিয় অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে আসা এক কৃতির সঙ্গে আলাপচারিতায় মগ্ন নীলাদ্রির মুখ থেকে বেরিয়ে আসা কথাদের মধ্যে শুধুমাত্র এটিরই বিক্ষেপ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিলো সেদিন স্বধার। "কানের ভিতর দিয়া মরমে" পৌঁছানো সব কিছুই যে ধনাত্মক হবে এমন আইন না থাকায় স্বধার তাকে আত্মিকরণে সমস্যা হয়নি বরং সে ভাবতে চেয়েছিলো যে সাতটি স্তর অতিক্রম করে কোনো ছেলেকে পুরুষ হয়ে উঠতে হয়, তা পেরনোর পর পরিখা বুজিয়ে দেওয়া হয় কেন? অথবা 'মেধা নাড়ি' জাগ্রত হলে যে কোনো পুরুষই কি প্রস্তর?


ইডেনের কেবিন ওয়ানে অদ্ভুত সুন্দর কুট্টি একটা ব্যালকনি আছে। খুব বেশী হলে চার পাঁচজন সেখানে একসঙ্গে দাঁড়াতে পারে। গ্রিলের ওপারে কোনো এক কালে প্রতিষ্ঠিত, বর্তমানে মৃত ব্যবসায়ীর গোলা, পরিত্যক্ত গ্যারেজ। বাঙালীর ব্যবসা এখনো 'এক পুরুষের' এই বদনাম ঘোচাতে পারেনি এই শহরতলিতে অন্তত, সেহেতু দীর্ঘ দীর্ঘ গাছেরা ক্রমেই দীর্ঘতর হয়ে শিকড়ের দিকের আগাছাকে জঙ্গল করে তোলার বন্য আনন্দ পেয়েছে। সাত পা একসঙ্গে হাঁটলে বন্ধু হয় অথবা সপ্তপদীতে যাপনের সঙ্গী? প্রথম সাত মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর স্বধার মনে হয়েছিলো অরণ্য ভালবাসে বলে তার সাতজন্ম লতা গুল্মে জড়িয়ে থাকার সুযোগ পায় নিয়ত। তবে তখনো সে জানতো না আগামী প্রায় সাতশ ঘন্টায় চাণক্য মতে প্রকৃত বান্ধব তার এই ছোট্ট নির্জনটুকুই হয়ে উঠবে। এই মুহূর্তে এই মধ্যরাতে এখানেই দাঁড়িয়ে কেন হঠাৎ সেদিনের ভাবনার কথা তার মনে পড়লো, কারণ খুঁজতে গিয়ে সে অন্ধকারেই হারাতে চাইল।


আলেকজান্ডার পোপ নামের কবিটি সেই অগাস্টান পিরিয়ডে যে অসামান্য কিছু কথা লিখে গিয়েছিলেন স্বধা সেগুলোকে মানে ভীষণভাবে, নিজেকে দিয়েই। "A little learning is a dangerous thing" পাতি বাংলায় যাকে বলে "স্বল্পবিদ্যা ভয়ংকরী"। নিজেকে বাচাল মেনে নিয়েছে এই কারণেই। পূর্ণ কলসে শব্দ হয় না। সে অত্যন্ত অগভীর, ফাঁকা তাই এত এত কথা আসে তার, এমনই মনে হয়। সেও ঐ মনতস্ত্ব বিষয়ে বিশেষ পড়াশুনা না করেই ফ্রয়েডিয় কোট আউড়ানো লোকগুলোর দলে যারা অবসাদগ্রস্ত কাউকে পাগল আখ্যা দিয়ে দেয় নির্বিচারে, উড়ে উড়ে আসা গল্প কবিতায়, ইউ টিউবের লিঙ্ক দেখে ওয়েদিপাউস আর ইলেক্ট্রার প্রসঙ্গ এনে ফ্যালে, অথচ একটু তলিয়ে ভাবলে, সামান্য অনুধ্যানেই স্পষ্ট হতো যে কোন নারী তার প্রার্থিত পুরুষের মধ্যে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে তার পিতাকেই সন্ধান করে এবং ভাইসি ভার্সা। কমপ্লেক্স ভিন্ন বিষয়। অতি সরলীকরণ কোনো জটিলতার না হওয়াই যুক্তিযুক্ত। 


স্বধার মনে হলো যেভাবে জয়েস নোরাকে লিখেছিলেন "তোমার সমাজ আমার শত্রু, তুমি নও", ঠিক সেভাবেই সে যে যে 'পুরুষ' দেখেছে এই তিরিশ অবধি তাদের অধিকাংশই পুরুষমাত্র, তন্ত্রধারী নয়। তাদেরকেও তার বলতে ইচ্ছে হয়েছে- 'আমি পুরুষতন্ত্রকে প্রতিপক্ষ মেনেছি, তোমাকে নয়'। পারেনি কারণ প্রকৃতি আর পুরুষের মূল ব্যবধান বাড়বাগ্নিতে। নারী এক জলজ সত্ত্বা, যে কোনো অভিঘাতের প্রতিসরণ তার আধারে বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। পুরুষ নিরেট এক অস্তিত্ব, উদ্বেদী শিলাকে ধারণ করে থাকা আপাত প্রতিক্রিয়াহীন ঘন অবস্থান। অভিমান শব্দ মাত্রেই রমণীয় মেঘ ভেসে আসে অথচ তার প্রকৃত স্বরূপ হয়তো পুরুষেরই করায়ত্ত। সে স্থির হয়ে যায়। মন্দ্র নিনাদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে নিস্তব্ধ কাঠিন্যে। যেমন কস্তুরীর বধবিন্দু তার শরীরস্থ ব্রহ্মকুণ্ডলীটিই ঠিক সেভাবেই পুরুষের অসহায়তা সে একজন পুরুষ'ই। একথা নীলাদ্রীকে পড়ে প্রথম জেনেছে স্বধা, পরবর্তীতে প্রতিটি ঈশ্বরসত্ত্বা, পরিযায়ী কিছু ঘনিষ্ঠরা তার পাঠকে নিবিড় করেছে, আপাতত ক্রাইস্ট শেখাচ্ছে আর একদম স্বচ্ছতায় আজ আরেকজনের বোধে দেখল। একটা গান মনে পড়লো- "একলা পুরুষ কর্তব্যে, একলা পুরুষ পিতায়"।

রিসেপশন থেকে আর্জেন্ট কল আসার পর দেখা করতে গিয়ে সে জেনে ফিরেছিলো ডক্টর সেনের বিশেষ নির্দেশের কথা। যেমত সে নিশাচর হলেও পাখি নয়, অসম্ভব বিধ্বস্ত মাথা আর শরীরের ইন্সট্যান্ট এলাইনমেন্ট সম্ভব হয়নি। বসে পড়েছিল। সামনে প্রবল অন্ধকার কড়কড়ে রোদ্দুরে, যতটা দৃশ্যময় তার থেকে অনেক বেশী অনিশ্চয় অদৃশ্যে। সে কোথায় নিয়ে যাবে এখন এই নিদ্রিত, অসুস্থ মানুষটিকে? তাবড় সেলিব্রিটিদের যেখানে আই সি ইউ পাওয়ার অপেক্ষা করতে হচ্ছে, স্বাস্থ্যভবন নথিকরণ বন্ধ করে দিচ্ছে ওয়েটিং লিস্ট মুনওয়াক হয়ে গেছে বলে, লকডাউনের রাস্তা দিয়ে যাওয়া প্রতি দশ মিনিটের ছটা গাড়ির মধ্যে তিনটে এম্বুলেন্সের, একটা শববাহী যানের। সে কোথায় নিয়ে যাবে? সে এমন রাষ্ট্রে বাস করে যা বিশ্বব্যাপী অতিমারির প্রথম ঢেউ প্রত্যক্ষ করার পর দেড় বছর সময় পায় পরবর্তী আঘাত আসার আর সেই অন্তবর্তী সময়টুকুকে উপভোগ্য করে তোলে শুধুমাত্র কয়েকটি রাজ্যের নির্বাচনী আমোদে। একশন প্ল্যান, হসপিটাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র তো দূর, একটিও অতিরিক্ত বেড, এক বোতল রক্ত, একটামাত্র সিলিন্ডারের সরবরাহকেও উপেক্ষা করে দিয়ে হত দরিদ্র জনসাধারণের করের অর্থভাণ্ডার দেউলিয়া করে দেয়  কোটি কোটি টাকার কপ্টার ভাড়ায়, ব্যাক্তিগত প্রচার বরাদ্দ খাতে। হায় দেশ... সে কোন দুয়ারে কড়া নাড়বে এখানে? নীলাদ্রীর ছাত্ররা ছড়িয়ে আছেন পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়, সামান্য হলেও কিছু মন্ত্রী সান্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিক স্বধাকে স্নেহে রাখেন কিন্তু তারা কি মহানগরীতে ময়দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন? না রক্তবীজি প্রজননে চিকিৎসকের জন্ম দেবেন কেন্দ্র রাজ্যের প্রশাসনিক মান রক্ষার্থে? থাকলো বাকি এই মহকুমা মফস্বল। যে হাজারে হাজারে গ্রামবাসীদের দুইদিন আগেও ট্রাক বোঝাই করে এনে এনে তারকা খচিত মঞ্চের মাঠ ভরানো হয়েছে ক্যাডারদের বিশ্বস্ত তত্ত্বাবধানে, তারা তো জানতেও পারেনি মাস্ক কী, দূরত্ববিধি কাকে বলে? অজান্তেই তাদের আয়ুর সুতো ছিঁড়ে গিয়ে এখন কাতারে কাতারে মাথা জমছে সরকারী হাসপাতালে ফলে নরককেও প্রতিযোগীতায় নামতে হচ্ছে ন্যূনতম পরিষেবার প্রেক্ষিতে। এ বস্ত্রহরণ পালার দুর্ভাগ্য রুখতে মাধবও প্রতিবন্ধী। তাহলে নীলাদ্রি কোথয় যাবেন? বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে তাকে? উদ্ভ্রান্ত স্বধার কল লিস্ট জানে পরপর সত্তর টি ফোন সে করেছিলো ইডেনেরই দুই তিনজন ওয়ার্ড বয় এমনকী সুইপারের হাতে মোটা টাকা গুঁজে দেওয়ার বিনিময়ে নম্বর জোগাড় করে (রাজপথে অন্ধকারের বিকিকিনি হয়না বলেই কানাগলি গুলো টিঁকে থাকে) সম্ভাব্য সমস্ত নার্স আর আয়াদের, পায়নি, একজনকেও নয়। 

নির্দেশ পাঠিয়ে দেওয়ার পর ঘুম তারও আসেনি। খুব ভোরে ডিউটি থেকে সরাসরি পৌঁছে গিয়েছিলেন ইডেনে। কেন, এর উত্তর জানা থাকা বলেই আয়নার সঙ্গে পুরুষদের বড়ই বৈরিতা। ভিতরে ঝড় বইলেও তাদের চোয়াল, ভাঁজ ফুটিয়ে তোলার বিশ্বাসঘাতকতা করে না। একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে কেবিন ওয়ানের দিকে তাকিয়ে রিসেপশনে যা জানানোর জানিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন যেখানে অপেক্ষায় তার আত্মা ও রক্তের পুত্তলিরা। রিসেপশন থেকে প্রতিনিধি এসে স্বধাকে জানিয়ে গিয়েছিলো, পূর্ব পরিচিত নীলাদ্রীর দায়িত্ব ডক্টর সেন অন্য কোথাও, কারোর হাতে ছেড়ে দিতে অস্বীকৃত হয়েছেন, তাকে ডিসচার্জ করা যাবে না। যখন স্বধা শুনছিলো এই কথা, দেখতে পেলো সায়রের গাড়ি পোর্টিকো ছেড়ে রাস্তায় নামলো সদ্য। 

নীতি, আদর্শ সব সব কিছুকে শব্দ মাত্র ধরে নিলেও সিংহের হৃদয় জানে 'একা' চারণের ক্ষমতা ধারণ করে বলেই সে নৃপতি। কাকে কৈফিয়ত দিয়ে এলেন সায়র আজ? নিজেকে? "ধরিত্রী দ্বিধা হও"- এক নারী উচ্চারণ করতে পারে, পুরুষ নয়। সে জানে তাকে নিয়ম গড়তে হবে, ভাঙতেও হবে অথচ কলঙ্কমাত্র যেন স্পর্শ না করে, সে দূরত্বও গাঁথতে হবে। 'টান' -অলীক এই শব্দকে পাঁজরে আটকে রেখে গলিয়ে নিতে হবে নীতিমালার শৃগালচর্ম। নাহলে তার ঘ্রাণে সহস্র হারপুন হাতে উল্লাসে ঘিরে ধরবে শ্বাপদদুর্লভ নৃশংসতারা। সে গরল নিজে নিয়ে নীলকণ্ঠ হবেন, এমনও এক্তিয়ার নেই। তিনি যে কারোর স্বামী, কারোর পিতা। তার সর্বস্ব দিয়ে হলেও স্বধাকে প্রত্যক্ষে আগলে রাখার অধিকার বা অনুমোদন কোনটাই তিনি নিজেকে দিতে পারেন না। শুধু আড়ালে থেকে নিরাপদ গণ্ডী টুকু কেটে দিতে পারেন মাত্র। কেউ যেন টের না পায়, যে লক্ষ্য সেও নয়। বজ্র দৃঢ় অথচ অসহায় এই পদক্ষেপের সংজ্ঞা- পুরুষ জানে, তার যমুনা নেই, কলসীও না। 


শুধু তাদের এটুকু জানা হয় না, সায়রেরও হলো না, 'ইনটিউশন' বলে যে শব্দটি আছে অথবা ষষ্ঠেন্দ্রিয়, তা নারীর অজ্ঞাত কিছু রাখতে দেয় না বলেই "স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা না জানন্তি, কুতো মনুষ্যা:"- এই প্রবাদ এসেছে। একটিও শব্দ উচ্চারণ না করলেও পুরুষের প্রতিটি আচরণের সুলুক সন্ধান নারীর কাছে প্রিজমের উজ্জ্বলতায় ধরা পড়ে। তার মনে পড়লো ভ্রূণহত্যা বা কন্যাসন্তান জন্মানোর অপরাধে খুনের খবরেরা যেদিন সংবাদপত্র আঁধার করে থাকতো, নীলাদ্রী লুকিয়ে রাখতেন। নৃশংস ধর্ষনকান্ডেরা যখন প্রচারমাধ্যমের খাদ্য হতো, স্বধার ঘনিষ্ঠ বান্ধবেরা চুপ হয়ে যেত কিছুদিনের জন্য হলেও। আজ সায়রকেও দেখলো সে, অবিকল হংলি, নিষ্পাপ জেনেও রুয়িকে কোল্ড প্যালেসে পাঠিয়ে ব্যাক্তিগত প্রহরায় রাখা সম্রাট। একটিই নরমে প্রত্যেকে বিদীর্ণ, পুরুষোচিত সংবেদন। নপুংসক পুরুষত্ব প্রমাণের দায়ে যখন যে মুহূর্তে কোনো মেয়ে আহত বা নিহত হয়, যে বা যারা মাথা নিচু করেন লজ্জায়, দীর্ণ হন আত্মসংকটে, সংগোপনে- অতি সংক্ষেপে তাদেরকেই স্বধা 'পুরুষ' নামে ডাকে। সম্ভবত সেই কারণেই কোনো এক সেমিনারে পেপার পড়ে নামার পর যখন এক বিশিষ্ট গবেষক তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন "Proud to see an emerging feminist" , সে গ্রহণ করতে পারেনি। কাষ্ঠ হেসে জানিয়েছিলো- "Thanks a ton but I would love to call myself a humanist as I have seen pangs of the first sex before learning mine" 


বেধড়ক সবুজে দুটো কাঠবিড়ালির বাসা। অষ্টপ্রহর ঝিলিক দিয়ে লাফিয়ে বেড়ায় শাখা থেকে প্রশাখায়। স্বধা তাকিয়ে আছে। ভাঙা রেমিঙটন পড়ে আছে জীর্ণ শেডের আড়ালে। অনেকদিন কিছু লেখেনি সে, অনেকদিন। মনে হয় কিছু দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত থাকে বলেই তারা অনন্ত আকর্ষণের, যেমন পুরুষ ও প্রকৃতির অথবা জল ও প্রস্তরের।

কে কাকে বোঝে?
কে কাকে বোঝায়?
কে কাকে বুঝতে দেয়?