Monday, November 8, 2021

এলেন গিন্সবার্গের কবিতা

 

এলেন গিন্সবার্গের কবিতা

 

সোনালী চক্রবর্তী

 

বিট জেনারেশনের অন্যতম প্রবক্তা আমেরিকান কবি আরউইন এলেন গিন্সবার্গের জন্ম ১৯২৬ সালে। তাঁর প্রতিটি কবিতা তীব্র প্রতিরোধের দলিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, অর্থনৈতিক আগ্রাসন আর যৌনতার অবদমনের বিপক্ষে। তাঁর সর্বাধিক বিতর্কিত কবিতা “হাউল” এর জন্য তাঁকে অশ্লীলতার দায়ে রাষ্ট্র কর্তৃক অভিযুক্ত করা হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এলেন তাঁর ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত অনাড়ম্বর যাপনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাপেক্ষে রচিত তাঁর “সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড” কবিতাটি বাঙালি উদ্বাস্তুদের মর্মন্তুদ বেদনাকে ব্যাখ্যায়িত করেছে। যে রাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর আমরণ জেহাদ পরবর্তীতে সেই রাষ্ট্রই তাঁকে বিভিন্ন সম্মানে সম্মানিত করেছে। আজীবন যুদ্ধের বিপক্ষে গান গেয়ে যাওয়া কবি এলেন ১৯৯৭ সালে নশ্বরতা থেকে মুক্তি নেন।

 

আসমানি ফেরেস্তাটি

সমুদ্রতীরের অধিত্যকায়, হামানদিস্তা গাছে হেলান দিয়ে,
মার্লিন এক যান্ত্রিক প্রেমের জন্য বিলাপ করছে।

সে এক পূর্ণাকার খেলনা, অমরত্বের পুতুল,
শুভ্র ইস্পাত নির্মিত অবাস্তব কোনও টুপির আকারের তার চুল।

পাউডারমাখা, চুনকাম করা তার মুখ যন্ত্রমানবের মতো স্থাবর,
কপালের পাশে, একটা চোখের ধার থেকে ঝিলিক দিচ্ছে একটা ছোট্ট সাদা চাবি।

চোখের সাদা অংশের ভিতর গাঁথা নিষ্প্রাণ নীল তারারন্ধ্র দিয়ে,
সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,
চোখ বন্ধ করতেই চাবিটা নিজে থেকে ঘুরে গেল।

সে চোখ খুলতেই, জাদুঘরের ভাস্কর্যের মতো তারা অমিত্রাক্ষর হয়ে উঠল,
তার যন্ত্র গতিশীল হয়ে উঠতেই, চাবিটি আপনা থেকে আবার পর্যায় বদলে নিল।

আপনারা হয়তো ভাবছেন,
অন্তঃস্থিত উৎপীড়নের সমাপ্তির জন্যে এ আমার কোনও পরিকল্পনা,
কিন্তু আমার চিন্তাকে দখল করে রাখবে,
এখনও অবধি এমন কোনও পুরুষ আমি খুঁজে পাইনি।

 

একটি ঊষরতার কথা

মেঘমুক্ত আকাশের মতো এখন চেতনা বিশুদ্ধ,
সুতরাং এখনই তো সময় বিজনপ্রদেশে গৃহ নির্মাণের।

চোখ দিয়ে প্রলাপ বকা ছাড়া কী-ই বা করেছি বৃক্ষে?
অতএব স্থাপনা হোক, দারা-পুত্র-পরিবার, যাচ্ঞা করি প্রতিবেশী।

অথবা, ধ্বংস হয়ে যাই একাকীত্বে, নতুবা ক্ষুধার তাড়নায়,
বা অশনিতে কিংবা মেনে নেওয়ায়,
(গৃহপালিত করে তুলতে হয় হৃদয় আর পরিধান করতে হয় সহ্য)

আর সম্ভবত গড়ে তোলা যায় আমার ঘুরে বেড়ানোর এক ভাবমূর্তি,
এক ছোট্ট প্রতিমা— পথের ধারের মন্দিরে— রাহীদের কাছে নিদর্শনের মতো—
এই উপবনে আমি অতন্দ্র জীবিত আর এই ই আমার গৃহ।

 

সর্বজনীন সম্ভাষণসমূহ

দাঁড়াও সরকারের প্রতিপক্ষে, তোমার ঈশ্বরের বিপরীতে,
হয়ে ওঠো দায়িত্ববোধহীন।
উচ্চারণ করো শুধু সেইটুকু যা আমরা জানি আর ধারণা করি।
স্বয়ম্ভুরা নিগ্রহপরায়ণ,
পরিবর্তন একমাত্র অসীম।
সাধারণ বুদ্ধি ধারণ করে নিত্য বিভাব।
প্রতিপালন করো যা অবিস্মরণীয়,
ঘোষণা করো যা তুমি গ্রাহ্য করছ,
লুফে নাও চিন্তারত তোমার মননকে,
অত্যুৎজ্জ্বলেরা স্বয়ং নির্বাচিত।
যদি আমরা কাউকে প্রকাশ নাও করতে পারি,
আমরা তো মুক্ত যা প্রাণে আসে তা লিখতে।
স্মরণে রাখো ভবিষ্যৎকে,
আমেরিকা মহাদেশে নাগরিক সম্মানের দাম কানাকড়ি।
মন্ত্রণা শুধু নিজেকেই দিতে পারি,
নিজের মৃত্যুকে পানীয় করে ফেলো না নিজের,
দুই অণু যখন পরস্পরের ঝন আওয়াজে সচকিত করে আমাদের,
তারও একজন পর্যবেক্ষক প্রয়োজন হয়
বৈজ্ঞানিক তথ্যের স্বীকৃতি পেতে।
পরিমাপের সূচকেরা নির্ধারণ করে দেয়
বিস্ময়কর পৃথিবীর আবির্ভাব।
(আইনস্টাইনের পরবর্তী সময়ে)
এই বিশ্ব আত্মবাদী।
হুইটম্যান উদযাপন করেছিলেন মানবতা।
আমরা দর্শকমাত্র, পরিমাপের সূচক, চোখ, বিষয়, ব্যক্তি।
এই মহাবিশ্ব আদি মানব।
আভ্যন্তরীণ মস্তিষ্ক বাহ্যিক করোটির মতোই বিস্তৃত।
চিন্তাশক্তির মধ্যবর্তী স্তরে কী?
এই চৈতন্য মহাশূন্য।
নিঃশব্দে, আমরা রাতের শয্যায় নিজেদের কী বলি?
“যা প্রথম উপলব্ধি, তাই শ্রেষ্ঠতম”।
বোধ সুষম, শিল্প সুগঠিত,
সর্বোচ্চ তথ্য, সর্বনিম্ন সংখ্যক অক্ষর,
ঘনীভূত অন্বয়, নিরেট ধ্বনি,
উচ্চারিত বাগধারার তীব্র বিচ্ছিন্ন অংশেরাই বিশিষ্ট।
ছন্দে এগোনো, স্বরবর্ণের আবর্তন,
স্বরকে ঘিরে থাকা হলবর্ণদের বোধগম্যতা।
স্বাদু হয় স্বরধ্বনি, মূল্যবৃদ্ধি ঘটে ব্যঞ্জনবর্ণদের,
শুধু তার দৃষ্টিসাপেক্ষে বিষয় জ্ঞাতব্য হয়,
বাকিরা তো দৃশ্যের পরিমাপ করে যা আমরা দেখি, তার ভিত্তিতে,
সরলতা হয়ে ওঠে মস্তিষ্কবিকৃতির হন্তারক।

 

কাব্য

এই পৃথিবীর ভার হল প্রেম,
একাকিত্বের চাপের নীচে,
অসন্তোষের বোঝার নীচে,
যে পাষাণ,
যে দায় আমরা বয়ে নিয়ে চলি,
তা প্রেম।

কে অস্বীকার করতে পারে?
স্বপ্নে প্রেম শরীর স্পর্শ করে,
চিন্তায় অলৌকিকের নির্মাণ ঘটায়,
জন্মইস্তক কল্পনায় মানুষকে পীড়ন করে চলে,
হৃদয় পেরিয়েও,
দাহ্য সে হয়েই চলে শুদ্ধি অর্জনে,
কারণ জীবনের দায়িত্ব প্রেম।

কিন্তু আমরা এই ভার পৌঁছে দি ক্লান্তিকরভাবে,
তাই বিশ্রাম নিতেই হয়,
ভালোবাসার ভুজে পরিশেষে,
বিশ্রাম নিতেই হয়,
প্রেমের হাতে সমর্পণে।

প্রেম ব্যতিরেকে নেই কোনও নিশ্চলতা,
প্রেমের স্বপ্ন ব্যতীত আছে যাবতীয় নিদ্রাহীনতা,
উন্মাদ হও বা সুশীতল,
দেবদূতদের নিয়ে অন্ধকার আবৃত থাকো বা নিছক যন্ত্র,
অন্তিম আকাঙ্ক্ষা প্রেম।
নির্মম হওয়া যায় না,
না যায় সত্যকে অস্বীকার করা,
প্রতিসংহারের উপায় থাকে না,
যদি প্রেম প্রত্যাখ্যাত হয়।

এ গুরুভার অতি দুর্বহ।

বিনিময়ে আসবে না কিছুই,
জেনেও দিয়ে যেতে হবে,
কারণ একান্তে বোধের অঞ্জলি কবেই সম্পূর্ণ,
গৌরবের সমস্ত সীমাকে লঙ্ঘন করে।

উত্তপ্ত শরীরদ্বয় যৌথতায় উদ্ভাসিত হয়,
অন্ধকারে, হাত পৌঁছতে চায় স্থূল দেহের কেন্দ্রে,
প্রশান্তিতে ত্বকের স্ফূরণ আসে অনাবিল,
আর আত্মা আনন্দময় হয়ে আবির্ভূত হয় চোখে।

এই সেই, এই ই তো সেই,
যা আমার অভিপ্রায়,
আমি সর্বদা প্রার্থনা করেছি,
আমি নিত্য কামনা রেখেছি,
প্রত্যাবর্তন করতে,
সেই শরীরে,
যেখানে আমি জন্মেছিলাম।

 

উন্মত্ত এতিম

রেলপথ আর নদীর ধারে,
বিনীতভাবে মা তাকে নিয়ে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে।
সে এক পলাতক, ক্ষমতাবান দেবদূত পুত্র।
আর তার কল্পনায় অনেক গাড়ি,
স্বপ্নে সে তাদের সবার সওয়ারী।

অবাস্তব মোটরগাড়ি,
আর মৃত, কলঙ্কিত মফস্বলের জীবাত্মাদের মধ্যে
এই উদ্ভিন্ন হয়ে ওঠা কি অসম্ভব নির্জন।

কি অসম্ভব একাকী,
শুধুমাত্র কল্পনায় ভর দিয়ে সৃষ্টি করা যে তার আরণ্যকের সৌন্দর্য নিছক পূর্বপুরুষের পুরাণ,
যা সে উত্তরাধিকার সূত্রে পায়নি।

পরবর্তীতে যখন সে স্মৃতির অপ্রকৃতিস্থ রশ্মিতে,
প্রহেলিকার মধ্যে থেকে জেগে উঠবে,
সে কি অলীক ঈশ্বরের অস্তিতে বিশ্বাস লালন করবে?

স্বীকৃতি,
তার অহং সাপেক্ষে যা অতি দুষ্প্রাপ্য,
তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে শুধু স্বপ্নে,
তার অতীত আর্তি,
শুধুই অপর কোনও জন্মের।

স্বত্বের একটি প্রশ্নে,
আহত তার আঘাত হারিয়েছে সরলতায়,
একটি লিঙ্গ, একটি বধকাষ্ঠ,
প্রেমের একটি পরম কৃতিত্ব।

আর পিতাটি,
মেধার জটিলতায়,
ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরে শোক পালনে রত।
অপ্রত্যাশিত এই প্রসঙ্গে সে অজ্ঞাত,
এক হাজার মাইল দূরত্ব থেকে,
প্রাণোচ্ছ্বল নবজাতকটি,
খিড়কি দুয়োরের দিকে এগোচ্ছে।

 


সিলভিয়া প্লাথ-এর কবিতা



সোনালী চক্রবর্তী

 

আন্তর্জাতিক সাহিত্যের ইতিহাসে যে নক্ষত্র তাঁর বিষাদের দ্যুতিতে চিরব্যাতিক্রমী, তিনি সিলভিয়া প্লাথ। ভাবতে বিস্ময় জাগে, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির বিদুষী, ১৯৩২ সালে জন্ম নেওয়া আমেরিকান সুন্দরী সিলভিয়া কী গভীর বিষাদে মাত্র ৩১ বছরের জীবদ্দশায় রচনা করেছিলেন “The Colossus and Other Poems”, “Ariel”, “Lady Lazarus” এবং প্রায় আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস “The Bell Jar” যা তার আত্মহননের সামান্য কিছু আগে প্রকাশিত হয়। প্রায় নিয়মিতভাবে তাঁর বিষাদের উপশমে মনোবিদরা প্রয়োগ করতেন ইলেকট্রিক শক। সবাইকে ব্যর্থ করে জ্বলন্ত ওভেনে মাথা ঢুকিয়ে ফ্রিডা আর নিকোলাসের মা, কবি টেড হিউজের স্ত্রী, ওটো আর অরেলিয়ার সন্তান সিলভিয়া জীবনের মতো মৃত্যুতেও তার শেষ কবিতা খুঁজে নেন। তিনিই সূচনা করেছিলেন ‘Confessional Poetry’ নামের লিটারারি মুভমেন্টের। ১৯৫৫ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে পেয়েছিলেন ‘Glascock Prize’ আর ১৯৮২ সালে মরণোত্তর ‘Pulitzer Prize for Poetry’।

 

সিলভিয়া প্লাথের কবিতা

সিন্ডারেলা

আরক্তিম রেকাবের মেয়েটির উপর রাজপুরুষটি ঝুঁকে থাকে,
যখন তালের সম কিছুটা মন্দ হয়ে আসে আর উল্টে যাওয়া বেহালায় ঘূর্ণিরা প্রসারিত হতে থাকে,
মেয়েটির সবুজ চোখ চমকে ওঠে,
রুপোর পাতের মতো চুলগুলো ফ্যানের হাওয়ায় ঝলসায়।

সুউচ্চ কাঁচ প্রাসাদের ঘরটিতে সবকিছুরই যেন অবিরাম পুনরাবৃত্তি,
যেখানে অতিথিরা মসৃণ আলোয় পিছলে যায় মহার্ঘ্য সুরার মতো,
ফুলেল বেগুনি দেওয়ালে গোলাপ সুগন্ধি মোমেরা ঝিকিয়ে প্রতিফলিত করে
লক্ষ লক্ষ বিপুলাকৃতি বোতলের উজ্জ্বলতা।

স্বর্ণখোদিত মিথুনেরা যেন এক ঘূর্ণন সম্মোহনে
অনুসরণ করে চলে সুদূর অতীতে শুরু হওয়া ছুটির দিনের আমোদ প্রমোদ,
যতক্ষণ না কাঁটা বারোটার কাছাকাছি পৌঁছায় আর আজব মেয়েটি হঠাত করে বিরতি নেয় অপরাধের অবদমন রুখতে,
ফ্যাকাশে হয়ে যায়,
আঁকড়ে ধরে তার রাজপুত্তুরকে।

কারণ,
বিভ্রান্তিকর সঙ্গীত আর মন্থিত পানীয়ের ভিতরে মেয়েটি অনিবার্য শুনতে পায়
দেওয়াল ঘড়ির মর্মান্তিক টিকটিকানি।

 

এক অভ্যুদয় বিশেষ…

রেফ্রিজারেটরদের মৃদু হাসি আমায় সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে দেয়,
আমার প্রেমিকাটির শোণিত শিরায় এমনই অশ্লীল বিদ্যুৎপ্রবাহ,
আমি শুনতে পাই তার বিশাল হৃদয়ের গরগর আওয়াজ।

তার ঠোঁট থেকে প্রতি মুহূর্তে আর শতাংশে চুম্বনের মতো সঙ্কেতের নিষ্ক্রমণ হয়,
তার প্রবৃত্তিতে কি সপ্তাহের সূচনা এখন? নীতিশাস্ত্র?

সাফাইয়ের পর ইস্ত্রি করে নিজেদের উপগত করা,
এই স্ববিরোধিতায় আমার করণীয় কি?
আমি পরিধান করি সফেদ হাতকড়া আর নুয়ে পড়ি।

এই কি তাহলে প্রেম? এই রক্তাভ বাস্তব?
ইস্পাতের সূঁচ থেকে উৎসারিত হয়ে যা কানামাছি হয়ে যায়?
এটি তো ছোট্ট ছোট্ট পোষাক আর আচ্ছাদনের নির্মাণকারী।

এটি রক্ষা করে একটি সাম্রাজ্যকে,
কীভাবে তার দেহ আবৃত আর অনাবৃত হয়,
একটি শৌখিন দুর্মূল্য হাতঘড়ি,
প্রতিটি কবজাই রত্নখচিত।

হৃদয় আমার… এ তো অরাজকতা,
নক্ষত্রেরা ঝলসাচ্ছে যেন করাল সংখ্যাসমূহ,
আর তার চোখের পাতারা গতের নামতা পড়ছে।

 

স্বকামিনীর অন্তর্জগতে…

প্রাণবন্ত, প্যাঁচানো, পরিণত-অতিক্রান্ত দুরত্বের খণ্ডগুলি যেমন,
নাবিকের মোটা খসখসে ওভারকোটের মধ্যে, স্বকামনার অভ্যন্তরে, পার্সি বশ্যতা স্বীকার করে,
ফুসফুসের কিছু থেকে পুরুষটি তখন ক্রমশ আরোগ্যলাভের দিকে।
স্বকামগুলিও অবনত হতে থাকে বৃহৎ কিছুতে,
তারা বিহ্বল করতে থাকে সবুজ উপত্যকার উপর তার নক্ষত্রগুলিকে যেখানে পার্সি সূঁচের ফোড়ের তকলিফকে পরিচর্যা করে আর হাঁটতে থাকে, হাঁটতেই থাকে।
বিষয়টিতে একটি সম্ভ্রম রয়েছে, একটি নিয়মানুগত্য,
ফুলগুলি পটির মতো তীব্র আর পুরুষটি সংস্কারে রত,
তারা আনত হয় আর টিঁকে থাকে,
তারা বরদাস্ত করে আকস্মিক আক্রমণ।
অশীতিপরটি ভালবাসে ক্ষুদ্র যূথগুলিকে,
সে যথেষ্ট অভিজাত,
নিদারুণ হাওয়া তাকে শ্বাসের চেষ্টা দেয়,
স্বকামিনীটি চোখ তুলে তাকায় যেমত শিশু,
রক্তশূন্য দ্রুততায়।

 

মৃত্যু এবং আসঙ্গ

দুজন, অবশ্যই তারা ‘দুই’জন পুরুষ,
এটা এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিকই ঠেকে,
প্রথমজন কখনও চোখ তুলে তাকায় না,
তার চোখগুলো ঢাকনাওয়ালা, ব্লেকের পাঁচালির মতো,
সে প্রদর্শনীতে বিশ্বাসী।

বণিকী মালিকানার সুপরিচিত সিলের মতো হয়ে গেছে তার জন্মদাগগুলো,
বাষ্প প্রদাহের ক্ষতচিহ্ন,
নগ্নতা,
শকুনির তাম্রমল,
আমি রক্তাভ মাংসখণ্ড, তার খাঁড়ার মতো নাক।

পাশে পড়ে থাকে হাততালির শব্দ,
আমি এখনও তার অধিগত হইনি।
সে আমায় বলে স্থিরচিত্রে আমি কতটা কদাকার,
ভীষণ স্বাভাবিকভাবে সে বলতে থাকে হাসপাতালের বরফ বাক্সে শোয়ানো শিশুগুলি কত মধুর।

ঘাড়ের কাছে ঝালর,
তারপর আদিম উপত্যকার বাঁশি,
মৃত্যুর আলখাল্লারা
আর ছোট্ট দুটো পা
সে হাসে না, ধূমপানও করে না।

অপরজন সেগুলো করে,
তার চুল দীর্ঘ কিন্তু আদতে নকল,
বেজন্মা
একটা ঝলকানিকে নিয়ে স্বমেহনে মেতে থাকে,
তাকে ভালোবাসা হোক, এটা তার চাহিদা।

আমি উত্তেজিত হই না,
ব্যর্থতা একটি ফুলের নির্মাণ করে,
হিম তৈরি করে একটা নক্ষত্র,
মৃত্যু ঘণ্টাটি,
মৃত ঘণ্টাটি,

কেউ তার কাজ শেষ করে ফেলেছে।

 

আমি শীর্ষদেশীয়

কিন্তু আমার হওয়ার কথা ছিল সমতল,
মাটির গভীরে শিকড় ছড়ানো কোনও বৃক্ষ আমি নই
যে প্রতিনিয়ত খনিজ ও মাতৃপ্রেমের স্তন্য পান করে
যাতে প্রতি বসন্তে আমার সমস্ত রশ্মি পাতায় বিকিরিত হয়।
মুগ্ধতায় নিজের অংশকে প্রলুদ্ধ করা, দর্শনীয়ভাবে চিত্রিত
কোন লাবণীও আমি নই
যে উদ্যান শয্যাকে খোলতাই করে।
জানতে পারার আগেই খুব দ্রুত আমার পাঁপড়িদের ছিঁড়ে ফেলা হবে।
আমার সঙ্গে তুলনায়, একটি বৃক্ষ অবিনশ্বর
আর একটি গর্ভমুণ্ড, নাতিদীর্ঘ কিন্তু অধিক বিস্ময়কর।
আমি একটির পরমায়ু কামনা করি এবং অপরটির স্পর্ধা।

আজ রাতে, নক্ষত্রদের অতি সামান্য আলোয়,
বৃক্ষ আর ফুলেরা তাদের শীতল ঘ্রাণ ছড়িয়ে চলেছে।
আমি তাদের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি,
কিন্তু তারা কেউ আমায় লক্ষ করছে না।
কোনও কোনও সময় আমার মনে হয়,
যখন আমি ঘুমিয়ে থাকি,
আমি অবশ্যই সবচেয়ে নিখুঁতভাবে তাদের মতো হয়ে উঠি।
চিন্তাগুলো ক্ষীণ হয়ে আসে।
আমার জন্য সবচেয়ে প্রকৃতিসম্মত হল শুয়ে পড়া,
তখন আমি আর আকাশ মুখোমুখি আসতে পারি মুক্ত সংলাপে।
আর আমি অবশ্যই বেশ ব্যবহার্য হয়ে উঠব যখন চূড়ান্তভাবে শুয়েই পড়ব।
তখন হয়তো বৃক্ষেরা একবারের জন্য হলেও আমায় স্পর্শ করবে,
আর ফুলেদের কাছে সময় থাকবে আমায় দেওয়ার জন্য।

সমীর রায়চৌধুরী


 

হিন্দিতে


 

ব্রতকথা

যেদিন জন্মেছিলাম

আকাশ ভাঙা প্লাবনের মতো

আমার দাদুর বাড়ির উঠোন জুড়েও

রূপ আর সৌভাগ্যের বান ডেকেছিল ।

পরে এসব উপকথা

শুনেছি...

যার রূপকথা শোনাতে

অধুনা অলীক সেই গোষ্ঠীরই কাছে

 

পরবর্তী ইতিহাস শুধুই পাঁচালি...


আজ...

 

প্রাসাদ নগরীর পশটাওয়ারের পুলে শুয়ে

প্রতি মাঝরাতে

জলে মদ আর মদে জলের মিশ্রণ অবান্তর হয়ে গেলে

নোনতা জলটাই বেশ মিষ্টি লাগে জিভে...

ওই নীচে, পিঁপড়ের মতো, ধুলোর উপর, মাঘের শীতে ঘুমোনি

অরক্ষিত

বাচ্চাটার মুখে আমি আয়না দেখি ।

আর লুব্ধক লুব্ধ চোখে তাকিয়ে বলে দেয়...

লক্ষ্মী বলে যারা ডেকে গেছে,

তারা বোঝেইনি

আমি এক ছিন্নমস্তা...

রুধির পান করতে করতে

সমৃদ্ধির দান ছড়াতে ছড়াতে

আমার আর কুমোরপাড়ার গলিটায়

পৌঁছোনোই হয়নি কোনও দিন

যেখানে অসমাপ্ত অদ্রিজা দেখে 

মহালয়ার রাতে 

সাজের নাতিকে ধমকে শিল্পী দাদু বলেন

ওরে... মায়ের মাথাটা লাগা... মাথা...

 

 

 

 

 
 

রসায়ন

আজ ব্যবহারিক রসায়নের একটা বই

নেযে চেড়ে দেখছিলাম...

পূর্ণমান একের পর এক প্রশ্নের উত্তরে

কোন এক অধ্যায়ের নীচে সেখানে লেখা ছিল

'যাতে লাফিয়ে না ওঠে

স্ফূটনাঙ্ক নির্ণয়ের সময়

তরল পদার্থে পোর্সিলিনের টুকরো 

তাই যোগ করা হয়'

ভেসে বেড়ানো বাষ্পীয় মন চিন্তাতরলে নিমজ্জিত মন

কত অনুভূতিরা দাবি করতে লাগল

মৌলিক আর যৌগিকের সম্মান

স্মৃতিরা উত্তাপ দিল প্রচুর

স্ফূটনাঙ্ক নির্ণয় হল না ঠিকই

তবে তুমি যে পোর্সিলিন ছিলে

অভ্রান্ত প্রমাণ কিন্তু সময় রেখে গেল ।
 

যখন মন কেমন করে




 

Sunday, November 7, 2021

প্যালিনড্রোম

 


"প্যালিনড্রোম

যেভাবে প্রতিটা একলা মানুষ অধিকতর একলা হ’তে চেয়ে দীর্ঘ কোনো মিছিলে হাঁটে, আমিও গুছিয়ে রাখি একান্তের উজ্জ্বল খুঁটিনাটি, ভাঙা আদর, রঙিন জোড়াতালি, নেশার ধূসর কৌতুক কিছু আর প্যালিনড্রোমীয় স্মৃতি। সন্ধ্যা নামলে সালতির কুপিগুলি স্থলের কঠিন থেকে সলতে বোধ হয়, কত যে ফল্গুর এখনো পোড়া বাকি...ভাবো তো, আবর্তন ব’লে আদৌ কিছু হয় কি? যে-কাশের দেউলে তুমি গাত্রহরিদ্রা এঁকেছিলে, গেল পূর্ণিমায় তা ময়ূর মুছে লবণ হয়ে গেছে, যে-চ্যুতি থেকে শিশু অশ্বত্থ আলোর হামা টানছিল, এখন হোম স্টে-য় পরিত্যক্ত বীর্যের চাষ করে। অথচ শূন্য আর দুই নিয়ে আজ একের যত হাড়হাভাতেগিরি। আয়নাকে হরবোলা মনে ক’রে আমি খুলে রেখেছি আঙুলের চামড়া থেকে নখরা, গ্রীবা থেকে হাঁস, পিঠ থেকে রডোডেন্‌ড্রন, সবই...স্মৃতি ফিরে এলে জৈন চন্দ্রাতপটিতে খুঁজো, যক্ষেরা দূত হয়, দাস হবে না ভেবে সিসিফাস যক্ষীরা বয়ে যায় জন্ম-জন্মান্তর ধ’রে ঝলসানো মাটির দায়।"

যৌতুক এবং সারভাইভাল ইন দ্য সেকেণ্ড

 

যৌতুক

প্রতিটা মেয়ের ছায়াতেই একটা করে ভাঙা বাতিঘর দেখতে দেখতে পুরো নাভিজন্মটা পেরিয়ে চলেছি অথচ কেউ আমায় উদ্ভিদ সনাক্ত করে উপড়ে দেওয়ার প্রয়োজন বুঝছে না। সিঁদুরে মেঘ কখন সহজিয়া পথ খুঁজে নিয়ে দেউলিয়া হতে চাইছে সামান্য জলের অজুহাতে, পারদের উপর কোনো আলো সেই প্রতিবিম্বের ঠিকানা চাইছে না। অর্জন ভাবতে বসলে মনে হয় কেন যে ডানা পুড়িয়ে পুড়িয়ে সামান্য কিছু হীরে খোঁজা হলো, এতো জানাই ছিলো আমার শ্যাওলার সেতার, যত নিপুণ ছড় ততই গর্ভস্থ মাটিতে বেহুদা জেগে থাকা কবরে ফুটে উঠবে প্রলাপ-এ-পারিজাত।

সারভাইভ্যল ইন দ্যা সেকেন্ড

বিষণ্ণ সিঁথিদের ঘিরে অসুস্থ জ্যোৎস্নার পরিক্রমা বিলাস দেখতে দেখতে ক্লান্ত হচ্ছি আমি। সময়কে নদী বলেই তো ডাকে মানুষেরা, ইদানীং তার জলেদের কাছে প্রতিটা সূর্য আলোর নামে একমুঠো করে বালি বয়ে আনে, চর দীর্ঘায়ুকামী। যদিও আক্ষেপের মানে ভাঙা বাঁশিতে ছিদ্র গোনা তবু মনে হয়, এত যে ভুলে যাই জনমভোর, প্রায় সব একদা প্রিয় কিছু, কেন শ্বাস নেওয়া মনে রেখে রেখে আয়ুকে ক্লান্তির অবসর দিয়ে যেতে হলো?


 

দুটি কবিতা

 

প্রস্তাব সমাচার

অজস্র হাতের ছায়া রঙ্গমঞ্চে,
মুদ্রায় ইঙ্গিত,
‘পাশে আছি’, ‘সাথে নাও’।

ফলত ব্যক্তিগত অন্ধকার অভেদ্য এক দূরত্বের জন্ম দেয়,
সেখানে শূন্যের ফসল প্রবণতায় সূর্য নিতান্ত বিরক্ত।
যেমত অঙ্গার অকারণেই কুসুমভুক।

অথচ ‘একা হও’ এই উচ্চারণ নিতে শ্বাস ছিলো নিজস্ব ইলতেহাবে,
যেভাবে চাঁদ খুঁটে খেতে খেতে শরবনের আতিশ ভাবে,
উন্মাদের বোধি কোনো সৎকার স্বীকার করে না কখনো।

চিড়িয়াখানা

দেখো বধ্য বলতেই তুমি বনের নাম নাও অথচ বাঘের মাথা কোনো ব্যাধেরই গৃহশোভা হয়না কোনদিনও। আউল দেখো রতি রতি ধানের গন্ধ খুঁড়তে গিয়ে হাঁসের বুক খালি। আর আমি দেখি তোমায়, সে কাজে জরুরি যা, পালকের পতন পেতে চৈতন্যে গর্দভকে ইহা গচ্ছ বলি। ছেঁড়া উষ্ণতা রিফু হবে, বারবার শৈত্যপ্রবাহ খুঁজে আনি সেই লোভে। বড় যত্নে তাকে আসন পেতে দাও হৃদপিণ্ড থেকে তেকোনা উনুন, সম্ভাব্য সব প্রস্রবণে। শিকার ও মৃগয়া এক খেলা নয়, দুজনেই সম্যক জানি। অতএব, শবদেহদুটি ঘিরে জ্যান্ত দশটি পিঁপড়ের উল্লাস চাখতে চাখতে থাবায় শুকিয়ে ওঠা রক্তের গন্ধে মসৃণ ঘুমিয়ে পড়ি।


 


লোকাচার

 

স্বপিণ্ডদান, আত্মশ্রাদ্ধ ইত্যাদি লোকাচার
 



গত রাত্রি একাদশী ছিলো, আজ শ্রাবণের দ্বিতীয় সোম দ্বিপ্রহরে উচ্চারণ করি- 'নম: স্বধায়ৈ স্বাহায়ৈ নিত্যমেব তবস্থিতি'। নাও,অনামিকা ছুঁয়ে নেমে গেলো অসংখ্য তিল, যে সমস্ত সন্তানদের আগমণ সম্ভবণাকে আমি হত্যা করেছি ডাকিনী মায়ায়,তাদের শিশু মস্তকগুলি ডুবে গেলো ক্রমে প্রবল শ্রাবণে। মরিচাদুষ্ট নিমের ডাল কটি দুয়ারে রাখা আছে। যে হাঁড়িতে আমার অন্ত্যেষ্টির চাল ফুটছিলো, পোড়া লাগা হেতু পিণ্ডগুলি সে প্রসব করেছ নিরন্তর ঘ্রাণময়। মাঙ্গলিক যে সবুজ পত্রটিতে আঁকা ছিলো কড়ি ও চেলী, তার রম্ভা মূলাংশের সামনে কুশের আসন। অগ্রদানী উপস্থিত নেই। উৎসর্গ দানের অপেক্ষায় বুভুক্ষু কাকের সারি। বিধিমতে শ্রাদ্ধশান্তি বহু আগে শেষ। কিছু কি বাকী?আজ এই অসম্ভব নীলে, যদি শান্তি তর্পণ না হয়, তবে কোনকালেই প্রেতযোনি থেকে পরিত্রাণ সম্ভব নয়। এমনই নক্ষত্র ইঙ্গিত ছিলো গত ষোড়শ প্রহরে। কালব্যাধি নির্ণয়ের পর একশত দিবস ছিলো আরোগ্যের। মৃত শবের ফিরে আসা ছিলো মাতৃক্রোড়ে। ভ্রম নয়, সে ছিলো শূন্য দর্শন কারন আত্মারামের কলস ভূমিতে আছড়ে ভাঙার পর আমি তাকিয়েছিলাম ফিরে। তখনও আমার চিতা আগলে চণ্ডালটি বসে শেষ আগুন উসকানোর ফিকিরে। আত্মার স্বস্ত্যয়ন আজ সম্পন্ন হলো। আমি মুক্তি নিলাম না দিলাম সেই উত্তরের সঙ্কেত গাঁথা তন্ত্র ও অলীকে।

টমাস ট্রান্সট্রোমার-এর কবিতার অনুবাদ

 


টমাস ট্রান্সট্রোমার (১৯৩১ – ২০১৫) <br />::অনুবাদ- সোনালী চক্রবর্তী

টমাস ট্রান্সট্রোমার (১৯৩১ – ২০১৫)
::অনুবাদ- সোনালী চক্রবর্তী

টমাস গোস্তা ট্রান্সট্রোমার ২০১১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি ছিলেন একজন সুইডিশ কবি, মনস্তত্ত্ববিদ এবং অনুবাদক। তাঁর কবিতায় জাপানি ঐতিহ্যের অবদান বিরাট। কাব্যিক চিত্রকল্পে তিনি ছিলেন একাকিত্বের রাজপুত্র। কবিতায় সম্পূর্ণ নিজস্ব ঘরাণার এক আবেদন তাঁকে তাঁর সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে বিশ্বসাহিত্যে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ছান্দ্যোগ্য

 

এক অদৃশ্য মর্মান্তিক ডানার মতো

জৈষ্ঠ্যের অরণ্য আজীবন আমায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।

তার গান গাওয়া পাখির ঝাঁক,

নিস্তব্ধ পুকুরে উন্মাদের মতো নেচে নেচে

অজস্র জিজ্ঞাসা চিন্হের জন্ম দিতে থাকা মশার শূককীট,

সব কিছুই।

আমি পরিত্রাণ খুঁজে ফিরি

একই গন্তব্যে, একই শব্দের কাছে বারবার।

যখন সূর্য তীব্র হয়ে ওঠে,

বরফ ড্রাগনের ঠান্ডা জিভ দিয়ে

সমুদ্র বাতাস আমার ঘাড়ের পিছন দিকটা চাটে,

আর উড়তে থাকা ডানাটা শীতল রোষে ভস্মীভূত হয়ে যায়।

 

 

একটি মৃত্যুর পর

 

কোন এক সময় পাওয়া একটা আঘাত,

ধিকধিক করতে থাকা ধূমকেতুর লেজের পিছনে পড়ে ছিল।

সে-ই চালিয়ে যাচ্ছিল যাবতীয় অন্তর্গত খেলা।

দূরদর্শনের ছবিগুলোকে বরফে মুড়ে দিয়ে,

হিমের দানা হয়ে দূরভাষের তারের উপর সেটাই জমে গেলো অনায়াসে।

 

ঝোপের ভিতর দিয়ে দিয়ে এখনো শীতের সূর্যের নিচে স্কি করা যেতেই পারে,

পুরনো টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে ছিঁড়ে নেওয়া পৃষ্ঠার মত অবিকল দেখতে কিছু পাতা যেখানে ঝুলে আছে,

শুধু সেখানে লেখা নামগুলোকে শীত গিলে খেয়েছে।

 

এখনো তো হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে সুন্দর লাগছে ভীষণ,

কিন্তু শরীরের সাপেক্ষে তার ছায়াকেই অধিক বাস্তব ঠেকছে।

আসলে যত বড় যোদ্ধাই হোক,

কৃষ্ণকায় ড্রাগনের আঁশের সমতুল

সমরাস্ত্রের পাশে দাঁড়ালে,

তাকেও তো তুচ্ছই লাগে।

 

সাংহাইয়ের রাস্তা

 

১।

 

বাগানের সাদা প্রজাপতিটাকে বহু লোক পড়ে ফেলছে,

আর ফড়ফড় করে উড়তে থাকা সত্যির একটা কোনা ভেবে আমি ভালোবাসছি বাঁধাকপির পোকা।

 

ভোর থেকে দৌড়তে শুরু করা ভিড়টা আমাদের শান্ত শিষ্ট গ্রহটাকে গতিময়তা দেয়,

তারপরেই পার্কগুলো সব ভরে ওঠে।

প্রতিটি মুখের জন্য উজ্জ্বল পালিশ করা আটটা পাথুরে মাথা আছে,

যাতে কোনও পরিস্থিতিতেই কেউ ভুল না করে বসে।

আরও আছে একটা করে প্রতিবিম্ব, যেখান থেকে প্রতিফলিত হয়,

‘সব বিষয়ে মুখ খোলা অনুমিত নয়’।

তবুও তো কিছু ঘটনা ঘটেই যায় শ্রান্ত কোন মুহুর্তে আর তাদের পরিণতি হয়,

বিষধর গোখরোর চোয়ালে,

আঁশময় দীর্ঘ স্বাদহীনতায়।

 

পুকুরে পোনার ঝাঁক সতত সঞ্চরণশীল,

ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও সাঁতার কাটে,

সর্বদাই ক্রিয়াশীল থেকে বিশ্বস্ততার নজির স্থাপন করা উচিত বৈকি।

 

২|

 

এখন মধ্যাহ্ন।

সাইকেলে চেপে যারা দুর্বোধ্য স্কুলগুলোতে এসে পৌঁছিয়েছে,

সমুদ্র বাতাস তাদের ধোপ দুরস্ত পোশাকে ঝাপটাচ্ছে।

দুটোই বিভ্রান্তিকর,

লখ্য করতে ভুলো না।

 

গতের চরিত্ররা আমায় ঘিরে রয়েছে যাদের অনুবাদ আমায় দিয়ে সম্ভব না,

একেবারেই নিরক্ষর আমি,

গন্ডমূর্খ যাকে বলে।

কিন্তু যা কিছু ধার কর্জ ছিল সবই শোধ করতে হয়েছে কড়ায় গণ্ডায়,

রসিদও আছে তার যথাযথ।

আমি সঞ্চয় করেছি শুধুই অপাঠ্য রসিদের বিরাট একটা স্তূপ।

এমন একটা বৃদ্ধ বৃক্ষ এখন আমি যেখানে বিবর্ণ পাতারা মাটিতে ঝরে না গিয়ে ঝুলে আছে,

সমুদ্র থেকে দমকা বাতাস এসে সমস্ত হিসেব যার এলোমেলো করে দেয়।

 

৩|

 

ভোরবেলা, দলবল যত পায়ে মাড়িয়ে আমাদের নীরব গ্রহটাকে ছুটতে বলে।

আমরা সবাই রাস্তার জাহাজে চেপে বসে ফেরি বোটের মত ঠাসাঠাসি হয়ে যাই।

 

আমাদের গন্তব্য কী?

সেখানে যথেষ্ট সংখ্যায় চায়ের কাপও কি আছে?

তবে কি এতেই যথেষ্ট সৌভাগ্যবান বিবেচনা করা উচিত নিজেদের যে আমরা জাহাজটার উপরে,

আর এখনো দমবন্ধ হতে হাজার বছর বাকি?

 

এখানে প্রত্যেকের মাথার উপর যে ছায়াটা হাওয়ায় ঝুলতে ঝুলতে হেঁটে বেড়ায় তা একটা ক্রুশ কাঠ,

সে প্রত্যেকের নাগাল পেতে চায়,

কখনো আমাদের অতিক্রম করে যায়,

কখনো সঙ্গে এসে দলও বাঁধে।

পিছন থেকে উঁকিঝুঁকি মারে,

দু হাত দিয়ে মাঝে সাঝে চোখ চেপে ধরে কানে কানে ফিসফিসিয়ে জানতে চায়,

‘বলো তো আমি কে?’

 


'প্র-অতি-পরা' লৌকিক

 

সোনালী চক্রবর্তী সিরিজ: ‘প্র-অতি-পরা’ লৌকিক

পয়লা বৈশাখ, ১৪২৭

প্রাচীন নগরীর চবুতরায় তিনি কুম্ভকে বহুদিন,
চাঁদ ভাসে, সূর্য ডোবে নির্লিপ্ত পরিক্রমায়,
আশ্চর্য মহামুদ্রা তার, যেমত প্রস্তর, উদাসীন।
নির্বাসিত সেই ছায়ার ভারে ইদানিং গোধূলির চোখ
অতিরিক্ত কাজল টেনে ফ্যলে।
ছেঁড়া প্রদীপের পদ্ম ভেসে এলে
পিঙ্গল সমুদ্রের আড়ালে শীতল আগুন প্রসারিত হয়ে নিমেষে মুছে যায়,
সেই নূপুর ছুঁয়ে আসা দল এত ফ্যাকাশে নয়।

মুকুট থেকে শিখীপাখা খুলে রেখে
ভিজে যেতে যেতে দংশন খোঁজেন আজও সেই প্রতারক।
সোনার অঙ্গখানির স্থান জুটেছে কুল কুণ্ডলিণী,
অথচ বিষাদনামায় দাসখত লিখেও
কেউ বুঝল না আজও,
কোন যাতনায় তার শরীরে রোহিনীর সওগাত রাই এরই নীলাম্বরি।

কথা এখানে শেষ নয়,
দুই শূন্যতার মাঝে এক রহস্য ঘাত আছে,
মিথিক্যাল মানচিত্রে এশিয়া সামান্য অঞ্চল মাত্র, কাল নিছক আপেক্ষিক,
অর্ধ মায়া আর অর্ধ শক্তির এনড্রোজেনাস যে কীর্তনটি পুরাণে নেই,
গর্ভস্থিত মহাকাব্যটি সেই প্রলয়ের সম্ভবনায় এখন সহস্র অক্ষৌহিনী রুদ্রাক্ষের সাজে।

 

শূন্যতা ফুরোলে

শ্বেতপাথরকে জড়িয়ে থাক আগুনের সাপ, দেখ নাভি থেকে কিছু ব্যথা ফ্লেমিংগো হয়ে উড়ে যাচ্ছে শেষ সন্তের খোঁজে। আদরের মত গেঁথে আছে কাদায় ব্রাহ্ম মুহুর্তে নিভে যাওয়া চিতার সোহাগিনী খই। যে তিল থেকে অপেক্ষা ধুয়ে গেছে তাকে ছত্রাক ভালবাসছে খুব, যে বৃষ্টিতে চাঁদ ভিজছেনা, তাকে বরং তুমি রক্তের ঝরোখাটুকু দাও। নিরাসক্তির বিপুল এক ঘোরে আছ জানি, নি:স্ব হতে হতে আমিও তো ভুলে গেছি কবে, যদি সব কিছুরই শেষ থাকে তবে শূন্যতারও আছে।

 

ভেসক্

কিছু মদালসা তাপ একটু আগেও আঁকড়ে ছিল রোদের শরীর সামান্য গণিকা স্বভাবে। ছায়ার অধিকার ঘনাল এমন, জেতবন মনে পড়ে। এ মহাবিশ্বের প্রতিটি ঘিঞ্জি জনপদে এখন তন্ত্র গুম্ফার অগম্য রহস্যের খেলা। অনাবিষ্কৃত লিপির অনন্ত নির্জনতাই কি তবে চক্র বিলাসে চেয়েছিলে ? যখন মনে পড়ে, তোমার বিধ্বংসী শান্তি সাম্রাজ্যের অন্তরালে, অন্ধকার চালচিত্রটিতে, জন্মান্তরের প্রেম সুমিধা, অভিশপ্ত যশোধরা যাপন ছুঁয়ে ভিক্ষুণী বদ্দকাচন্নায় অর্হৎ এঁকেছিল, সহস্র বিকৃতি, বিপর্যয়েও ঐ স্মিত মৌনতা আর বিষণ্ণ কীভাবে করে? অবতার মাত্রেই সম্যক জেনে ধরায় আসে, বোধির অর্থ বধিরতা, মানুষ কোনোদিন উচ্চারণ করবে না পাপের ভয়ে। সংঘের ঘণ্টা নিনাদে, আস্ফালন আজও তোমার আয়ত পাথর থেকে ভাসিয়ে দেওয়া শীতল উচ্চারণ সমূহের। অনুসারী রাজন্যেরা অতএব রাষ্ট্র নির্বিশেষে সংহত রাখে স্নায়ু ও দ্রোহ কৌশল। পায়েসভুক সিংহের উচ্চকিত হতে নেই লৌকিক রমণ অথবা রাজকীয় সন্ন্যাস, তারা দীক্ষিত এই নির্বানে। দেখ আজও আলোকে গনিমত করে কী প্রখর চাঁদ উঠেই গেল ভার্জিন আকাশে। তোমার নামের মন্ত্রে মূর্খ মানবেরা সহিংস তাড়নায় হাতড়ে ফিরল অহিংস ওয়ালপেপার বহুজাতিক বিলাসে। এরপর তো মেনে নিতেই হয় পৃথিবীর প্রগাঢ় প্রেমের কবিতাগুলো চিরকাল শ্রেষ্ঠ প্রতারকেরাই লেখে।

 

পুনরাবৃত্তি

সারসের নগ্নতা থেকে যে আলো ঠিকরালো দগ্ধ পাঁজরের মত ঘাতক হলোনা। আটটি কুনকি পথ ছেড়ে দিলে অরণ্যের পায়েস অধিকারে আসত করীটির, মুঠোর মাছরাঙা বিহ্বল করায় দাবানলকে তার পাত্রে সহাস্যে অঙ্গার উৎকোচ দিতে দেখা গেল। যে বৃক্ষের পাখিকে আকাশ নীলাভ শৈত্য উপহার দিল, জেনে রাখা ভাল তার শিকড়ে সর্পের অধিবাস ছিল না। বড় ফাগ উড়ল হে বৃহন্নলা বসন্তে আর পুইঁয়ে লেগে অনাঘ্রাত থেকে গেল বর্ষা বিদ্ধস্ত কমলা রঙের বেস্ট ফটোজেনিক ফুলটি। শ্বাস তো প্রবল বইলোই কোথাও, খোঁয়াড় মানুক আর নাই বা মানুক, যে আসন ‘এক’ তশরিফ চিনে নিদ্রিত ছিল এতদিন, তার প্রত্যেক আঁশ অজপা হলো। ১৪১ তম মেহফিলে ব্যবসায়ী ঝাড়বাতিরা সিজোফ্রেনিক মস্তিস্কে শখের ঝুুুলন নামিয়ে এঁকে দিল কারফিউ রাতের হাড়কাটা গলি। একটাই আফসোস, এই অঘোরেও গতের অধিক কোন অনুর সরণ ঘটল না। নিষ্ঠার মত পিচ্ছিল ইতিহাস যে নৌকা উল্টোতে বোড়েদের সাজাল, তার হালেও চারটি অক্ষর খোদিত ছিল, পুঁতে যাওয়া চাকার দাগে মুছেই গেল যাবতীয় মন্ত্রগুপ্তি।

 

সংকেত

দেখো, পৃথিবীর শেষ চরে অলীক ও অসম্ভব ঝড়ের নাভি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, যে বাঁক থেকে চাঁদ মুছে যায় মাঘী কুয়াশায়, না ওঠা সূর্য শালুকে ডুবে থাকে আনপ্রেডিক্টেড বর্ষায়, কোন এক আদি প্রবাহের উৎপাটিত প্রস্তরের মত নির্জন হয়ে আছি বিলুপ্ত অহমিকায় । ধীবর আতঙ্ক গাঁথা পঙ্গু মৎস্যকন্যাদের মৃত নিয়তিময়, এই উপকূলের নির্লিপ্তি শেখায় কীভাবে উপেক্ষার প্রস্তররাজিতে চৈতন্যছায়া ঘনায় । পাঁজরমধ্য যে বিন্দুতে নিদ্রিত শ্বাস ভাসমান আবর্তিত আলেয়ায়, কখনই সেই দিব্য স্বরূপের ভূমিকা মহীয়ান হয়না জাগতিক তুলায় । তবু এই গর্ভগৃহে নিত্য শৃঙ্গার, যদি কোন একদিন বোঝে ভূমিপুত্র, নাল বিচ্যুত হলে পদ্ম শুধু আর্দ্রতা নয়, উৎসর্গের অধিকারও হারায় ।

 

সোনালী চক্রবর্তী

কবি , প্রাবন্ধিক , সম্পাদক ও অনুবাদক । জন্ম বারাণসীর পীতাম্বর পুরায় । বেড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি , দার্জিলিং ও কার্শিয়াং মিলিয়ে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। ২০১৬ সালের ২৫ শে জানুয়ারী বাংলাদেশের ‘প্রথম আলো’র মাধ্যমে প্রত্যক্ষ লেখালিখির জগতে যুক্ত হওয়ার আগে পরিচয় ছিলো ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পী । বর্তমানে লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে গবেষণারত ।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ “জামার নীচে অলীক মানুষ” (২০১৭) ও “পদ্মব্যূহে নিম অন্নপূর্ণা” (২০১৯) । সম্পাদিত গ্রন্থ “ষটচক্র” (ভারত বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগ, ২০১৯) ও “সম্পাদিত বাক্” (২০১৯)।

কবিতার সঙ্গে নিয়মিত অনুবাদ করছেন বিশ্বসাহিত্যের নানা প্রান্তর। সাহিত্য পত্রিকা ‘বাক্’ পত্রিকার সম্পাদক ।
যোগাযোগ- sonali9191@gmail.com



দুটি কবিতা

 

হিপোক্রিট 

শোনো হে যক্ষ, মিথিলা সনদ এলে শৈব মেঘ ছিঁড়ে কিছু পালক নামে, তুমি তাকে তুষার ভেবে হাত পুড়িয়ো না। কীভাবে বলি, দাউ দাউ টের পেতেই হিরণ্ময় পলায়নে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলো যে মানুষেরা, শেখানোর সময়ই পাইনি যাদের ভিজে কাঠ থেকে ধোঁয়া ওঠার অঙ্ক, তাদেরই দেখেছি ঘর বেঁধে, পাখি পুষে, পাহাড়ি ছবির ফ্রেমে ঘোড়া ভাড়া নিতে। শিখেছি, মৃত শুক্রাণুর যাপনকে বকলেসে আঁটা উল্কা ভাবতে ভাবতে কীভাবে টাঙানো যায় আত্মপ্রতারণার মহতী সামিয়ানা। তুমি বলতেই পার, এখানে আমি কোথায় আছি? দেখো, মেঘ পোড়াক বা রোদ্দুর ভেজাক, চুতিয়া চাঁদকে ডোবানোর নখরা কোনোদিন আকাশ বা তার পোষ্য নক্ষত্ররা করেন না। 

 

পেগে ঈশ্বরছায়া ঘনালে

বয়স হচ্ছে আমারও, অথচ তোমার থেকে দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে । এত চক্র, পদ্ম এঁকে শেষে দেখাচ্ছ চামড়ার নিচে শুধুমাত্র রক্ত থাকে? একটা সময় ছিলো যখন তুমি ছুঁলে, যে কোনো প্রান্ত, অস্থায়ী নাভি… ইত্থুসে ব্রহ্ম। অহং ছিলো, সাধক দেখেই অনিবার্য ব্যঙ্গ, এত নির্বাণ নির্বাণ করো কেন? তাকিয়ে দেখো, ইচ্ছেমৃত্যু চেয়ে মাথা কুটছে বেধড়ক আনন্দ। এখন শুধু মনে হয় আমার অস্তিত্বের শ্রেষ্ঠ ফ্যাসিস্ট তোমার ঠোঁট থেকে একটাই কথা আসছে, হে শূন্যতা, পায়ে চুমু রাখো, জারজ বিষণ্ণতা থেকে তোমারও মুক্তির সময় এলো। আর আমি নাদান নাবিকের বিশ্বাসে শেষ প্রেমের নুমায়েশ রেখে জানাচ্ছি, আয়াত ভুলে যাবে এতটা জুইঁ এঁকে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে হৃদিতে, যদি আরেকবার তোমার নামে অজপা হই, চাঁদ কি আমায় নাস্তিক ডাকবে?



লাইকা

 

ধাতব পাত্রের আধার। যাতে ক্লান্তিতে শুতে না পারি, ব্যথায় পাশ ফিরতে না পারি, মৃত্যু এলেও বসে না পড়ি, প্রতিটা অঙ্গ শিকলে বাঁধা যেন একটা নখও সামান্য স্থান পরিবর্তন করতে না পারে, পাত্রের আধার এতোটাই সংকীর্ণ। আমার মুখে পরানো আছে লৌহ নির্মিত কঠিন মুখোশ, অনেকটা রেসের মাঠের ঘোড়াদের যা পরানো থাকে, জকিরা প্রাণান্ত ছুটিয়ে যাদের দৌঁড়ের বাহবা আর গর্ব তাদের ওপর বাজি ধরা শৌখিন বড়লোকদের মুকুটে তুলে দেয়। এও তো বাজি’ই বোধহয়, নাহলে শ্বাস নেওয়া থেকে রেচন অব্দি শারীরবৃত্তীয় চক্রের প্রতিটা পর্যায়কে এমনভাবে যন্ত্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত কেন রাখা হবে? কেন আঠালো রাবারের মতো খাদ্য ইঞ্জেকশান দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে ভারসাম্য ঠিক রাখা হবে আমার ওজনের, রক্তচাপের সঙ্গে?

আজ এই নিয়ে এ অবস্থায় তিনদিন। প্রথমদিন যখন আমায় এখানে আনা হলো বরফ পড়ছিল ভীষণ।  আমার মন বলছিল প্রকৃতিকে শেষবারের মতো এই শেষ দেখা, তাই চোখ মেলে দেখছিলাম, বেশি সময় তো পারিনি। ভীষণ শিক্ষিত ও গম্ভীর দুই বৈজ্ঞানিক, যাদেরকে আমার অতন্দ্র প্রহরী হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে তারা বড়ই কর্তব্যপরায়ণ। খুব দ্রুততায় আটকে দিলেন আমায় এই আধারটায়। আমি ককিয়ে উঠতে চেয়েছিলাম। আতঙ্কে, ধাতব মুখোশ পেরিয়ে শব্দ বেরোয়নি, শিকল ছিঁড়ে গিয়ে হাত-পা সরেনি এক ইঞ্চিও। শরীরে দয়া-মায়া থাকার জন্যই হোক অথবা পরীক্ষার সাফল্যের জন্য আমায় বাঁচিয়ে রাখাটা অপরিহার্য বলেই হোক, একটা গরম জলের নল আটকে দিতে দেখেছিলাম তাদের এই পাত্রটায়। বরফ শৈত্যকে ঢাকতে তার’ই তরল অবস্থার অ্যানটিডোট আর কি। যে কোন যন্ত্রণাকেই সময় উপশম দেয় কিনা জানি না, তবে বৌদ্ধিক আর শারীরিক অনুভূতিগুলোকে ক্রমশ ভোঁতা করে দেয়,একথা ঠিক। নাহলে প্রথমদিনের থেকে দ্বিতীয় দিনে আমার তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘোর আসতো না। আর তৃতীয় দিন থেকে আমি অপেক্ষা শুরু করতাম না এই ধোঁয়াটে, ঝাপসা হয়ে আসা অবস্থাটার একেবারে শেষ হয়ে যাওয়ার। আমি স্বপ্ন দেখতে ভুলে যেতে পারতাম না এতো সহজে। সেই রাস্তার কোণটা, যেখানে প্রতি বিকেলে একজন আমায় এক ঝলক দেখার জন্য পার্কে আসতো, তাকে আর দেখতে না পাওয়ার বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতে পারতাম না।

আমার শারীরিক অবস্থাকে গত তিনদিনে এমন স্তরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, যেখানে একটা মূল প্রশ্ন আমি নিজেকেই করতে ভুলে গেছি- “কেন আমি এখানে?” আমার নিজের কাছে এর কোন উত্তর নেই। কারণ অতর্কিত আক্রমণে শীতের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছিলো আমায়,আমি রোজকার মতো হাঁটতে-হাঁটতে রাতের খাবার চিবোতে-চিবোতে মহার্ঘ্য, অত্যাধুনিক মস্কো শহরে আমার অস্থায়ী বাসস্থানে ফিরছিলাম যখন। বুঝে উঠতে পারিনি, অজস্র আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিলো মধ্যরাতের রাজপথে। ক্ষণিকের ব্যবধানে বুঝেছিলাম বহুল দামী, অনেক সরকারী গাড়ির হেডলাইট এক সঙ্গে জ্বললে বোধরাও গুলিয়ে ফেলে সূর্য না প্রযুক্তি, কার কাছে সে মাথা নোয়াবে? আমি তো পড়াশুনা করার সুযোগ পাইনি কোনোদিন। নাহলে বিনা অপরাধে আক্রমণ মারফত আমার আমিকে ছিনিয়ে নেওয়ার এই পৈশাচিক প্রক্রিয়ার জন্য বিতর্ক আনতে পারতাম রাষ্ট্রের অধিকার সংক্রান্ত। কিন্তু আমি অসহায়। যারা আমায় নিয়ে এলো, তাদের প্রয়োজন ছিলো না কৈফিয়ত দেওয়ার। আমি তো ছিলাম পরিচয়হীন ভবঘুরে। তকমা আঁটা বৈধ দোপেয়ে নাগরিক তো ছিলাম না। তাদের প্রয়োজন ছিল একটা উপযুক্ত শরীর। আমি আমার তিন বছর বয়সে প্রায় ছয় কেজি ভর নিয়ে সে যোগ্যতার মান উত্তীর্ণ হয়ে পড়েছিলাম নিজের’ই অজান্তে। তাই লুণ্ঠিত হয়েছি প্রকাশ্য জনপথ থেকে। সে খবর স্থানীয় সংবাদপত্রে বেরোয়নি। তবে সে রাতেই বুঝেছিলাম রাষ্ট্রযন্ত্র কী নিদারুণ। তার প্রয়োজনে সে তার অধিকারে থাকা যে কোন কিছুকে চরম নির্লজ্জতায় গ্রাস করার জন্য সদা তৎপর। থাক সে কথা।

যেখানে প্রথম আমায় তুলে নিয়ে আসা হলো, দেখলাম সেখানে আমি একা নই;আরও দুজন আছে, তবে তারা পুরুষ। অদ্ভুতুড়ে সব যন্ত্রপাতি ঠাসা ঘর। আমি গিনিপিগ হয়ে জন্মাইনি জীবকুলে, নাহলে হয়তো রক্ত স্রোতে বাহিত বংশানুক্রমিক জ্ঞানেই বুঝতে পারতাম কী ঘটতে চলেছে আমাদের সঙ্গে। শুরু হলো যন্ত্রণাময় সেই পর্ব। অতি উচ্চমানের বৈজ্ঞানিক গবেষণা আর ফ্যান্টাসি নামের সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দিয়ে বহু তারকা চিহ্ন যুক্ত অতি নীল ছবির নির্মাণে যে মূলগত কোন ব্যবধান’ই নেই, সে বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা যদি উপন্যাসে লিখে প্রকাশ করার সুযোগ পেতাম, বেস্টসেলার লিস্টে হটকেক হয়েই যেত অন্তত কয়েক বছরের জন্য, এ দাবী আমি নিশ্চিতভাবে করতে পারি। প্রায় দিন কুড়ি সহ্য করতে হয়েছিলো সেই বিভীষিকা। শেষ দিকে শরীর থেকে বর্জ্য নির্গমন প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো। যে ব্যাগ আটকে দেওয়া হয়েছিলো শরীরের সঙ্গে, ফাঁকাই থাকতো। ল্যাক্সেটিভ প্রয়োগেও কাজ হয়নি বিশেষ। ভয়ে, অবিশ্রামজনিত কারণে হৃদস্পন্দন প্রায় দ্বিগুন আর রক্তচাপ চরম সীমায় উঠে যাচ্ছিলো বার বার। শেষদিকে গবেষকের চেহারায় বেশ হতাশা দেখতাম। বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না বলেই তাদের হতাশা আমাদের আশা দিতো মুক্তির।

এই পর্বটায় ঘটা একটা বিশেষ ঘটনার কথা আমাদের তিনজনের’ই বেশ স্মরণ আছে। বিশেষ কারণ সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খলিত সিস্টেমে, সেটা ছিল “ব্যতিক্রম”। যেখানে রোজকার জীবনে শ্মশানের শান্তি আর নৈস্তব্ধ বিরাজ করে সেখানে যদি প্রথমে একজন অভিযোগের আঙুল ওঠায় কারোর দিকে, আর তা জন্ম দেয় বিতর্কের, আর বিতর্কের পারদ চড়তে চড়তে উচ্চগ্রামের কলহে রূপান্তরিত হয়, সে এক মহাজাগতিক ঘটনার মতই বিস্ময়কর নয় কি? ভাষা খুব বেশি উদ্ধার করতে না পারলেও যেটুকু বুঝেছিলাম সংঘাত মূলত রাজনীতির সঙ্গে বিজ্ঞানের, আবহমান কাল ধরে যা চলে আসছে, তার’ই নবতম সংযোজন। রাষ্ট্রনায়ক চেয়েছেন তার প্রথম সাফল্যকে ছাপিয়ে যেতে অতি দ্রুত দ্বিতীয় সাফল্যের উড়ানে; আর এক ঢিলে দুই পাখির মতো বলশেভিক বিপ্লবের ৪০ তম বর্ষপূর্তি উদযাপন করতে। অথচ প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন মাত্র ৪ সপ্তাহ। ফলে বৈজ্ঞানিকদের তাদের অধীত সমস্ত জ্ঞানের বিরুদ্ধে গিয়ে সায় দিতে হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় অতি নিম্নমানের অপরীক্ষিত যন্ত্রপাতি ব্যবহারে, কাঠপুতলী অথবা ক্রীতদাসের মতো। কী লাভ এই শিক্ষার? এই জ্ঞানের? আমি এই সব প্রশ্ন তোলার কে যদিও, তবু বড়ই যন্ত্রণায় দীর্ণ হয়েছিলাম দেখতে দেখতে। এরাও কতো অসহায়। এতো মেধা, বিদ্যা, পাণ্ডিত্য নিয়ে ক্ষমতার কাছে কী বাধ্যতামূলক পরাজয় এদের। অনেক খুঁজেও কোন পার্থক্যই নজরে আসেনি সেদিন আমাদের তিনজনের সঙ্গে ওদের। কী এক অসম লড়াই, মানবতা আর শাসনের, অনাদি অনন্তকালের। সত্যি তিনি’ই ক্রান্তদর্শী যিনি বলে দিয়েছিলেন- power tends to corrupt and absolute power corrupts absolutely.

হঠাৎ একদিন দেখলাম সবচেয়ে বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকটি, শ্বেতশুভ্র যার চেহারা, যিনি দিনে একবারের বেশি আমাদের অন্ধকূপে ঢুকতেন না, সব শিকল খুলে বড় আদরে নিয়ে গেলেন তার বাড়িতে। অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক তাকে স্যার সম্বোধন করলেও তার নাম লোকমুখে শুনেছিলাম ড. ভ্লাদিমির ইয়াজদভস্কি। তার হাতের নরম স্পর্শে যখন আমার চোখ জড়িয়ে আসছিলো বহুদিনের না আসা ঘুমে, দ্বিতীয়বার আক্রমণের শিকার হলাম। অবাক হয়ে চেয়ে দেখলাম চোখের কোণ চিকচিক করলেও তিনি বাঁধা দিলেন না। বুঝে নিলাম, মুক্তির মেয়াদ এ পর্যন্তই ছিল। এই সাময়িক আনন্দ অজানা যাত্রার আগে পাসপোর্ট তৈরির বিরতি মাত্র। তার পরের ঘটনা এই ধাতব পাত্রের আধারে আমার গত তিনদিনের অবস্থিতি। কবে আমাকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছিল খেয়াল না থাকলেও এখানে আমায় ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর মুখে একজনকে বেশ জোরেই উচ্চারণ করে খাতায় নোট নিতে শুনেছিলাম- “31st October,1957. 3 days to go”।  হারনেস পরানোয় ঘাড় ঘোরানোর সুযোগ না থাকলেও বেশ বুঝতে পারতাম এখানে

অক্সিজেন সরবরাহ আর আমার শ্বসন থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণের সব যন্ত্রপাতি মজুদ, নাহলে ছিদ্রহীন পাত্রে টিকে আছি কী করে? একটা পাখাও লাগানো আছে কিন্তু চামড়ায় ফোস্কা পড়ার মতো আধারের তাপমাত্রা বৃদ্ধি নাহলে তা ঘোরে না, স্বয়ংক্রিয় নিশ্চয়।

. . . . . . . . .

প্রায় নির্বীর্য হয়ে আসা আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে এই মুহূর্তে কিছু ঘটতে চলেছে। অশুভ, চরম কিছু যা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর সময় আমি টের পেতাম ভূমিকম্প, অগ্নুৎপাত, জলোচ্ছ্বাস অথবা, দাবানলের অব্যবহিত আগে। আমি নির্ভুল ছিলাম এবারেও। অসম্ভব একটা ঝাঁকুনি। প্রকৃতির সব প্রলয়কে একত্রিত করলে যে ধ্বংসের সৃষ্টি হতে পারে তাই যেন অনুভব করতে পারছি এখন। একি প্রাকৃতিক আদৌ না প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়ার অপ্রাকৃত প্রয়াসের ফলশ্রুতি? জানি না। শুধু বুঝতে পারছি অন্তিমকাল আসন্ন। এই তীব্র কম্পন হৃদপিণ্ডকে শরীর থেকে আলাদা করে দিচ্ছে। মস্তিষ্ক তার চিন্তা প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে ক্রমশ। আহ, অন্ধকার …

পৃথিবীর কোন এক ধর্মে আত্মার উল্লেখ আর প্রামাণ্য নথি আছে। যে অবস্থায় এখন বিরাজ করছি মহাশূন্যে, পরম নিশ্চিন্তে, নির্ভার ভাসমান তাকে ব্যাখ্যা করার সম্ভবত এই একটি’ই সূত্র আছে- “ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন নায়ং ভুত্বা ভবিতা বা ন ভুয়হ/ অজো নিত্যহ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে”। প্রত্যক্ষ করছি নির্বিকল্প ঔদাসিন্যে ঐ ধাতব আধারের বাড়ির সামনে, যার নাম ‘সামরিক গবেষণা কেন্দ্র’, আমার মূর্তি বসছে। হাস্যমুখ, গর্বিত, উদ্ধত, মূর্তি আমার। হাসি-গর্ব-ঔদ্ধত্য আমার হত্যাকারীদের। আমার মৃত্যুর রহস্য উচ্চপর্যায়ের সরকারি তদন্তের শীতল মর্গে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, যাতে অন্তত কয়েক দশক তা প্রকাশ না পায়। ভবঘুরের নাম থাকে না কিন্তু নথিতে মংগ্রেল প্রজাতিভূক্ত আমার দুটো নাম বসে যাচ্ছে। একটা গালভরা পদবী যুক্ত- “কুদরিয়াভকা”, আরেকটা শখের ডাকনাম “কার্লি”। ইতিহাস তো মনুষ্যনির্মিত বিকৃত তথ্য মাত্র, তাই উইকিপিডিয়াতে আমার পরিচয় খুঁজলেই প্রথম লাইনটা ভেসে উঠছে- “প্রথম জীবন্ত প্রাণী হিসাবে মহাকাশযাত্রার সৌভাগ্য অর্জনকারী”।

… আমি লাইকা।


 


অথ জীবন

 পোষা কাছিমটির পিঠ জুড়ে রঙিন ঘুড়িদের আঁকলে দিন ভোর, আদর করে সুতো দের পাখি নামে ডাকতে ডাকতে ফুরিয়ে দিলে রাত অথচ আচারি সুবাস ছড়ানো ঘুম ঠাসা আদিম বয়ামের ভিতর কোন ফানুসও তোমায় ভাসিয়ে তুললো না।

এই সনাতনী ব্যর্থতায় বাকি ভাণ্ড টুকু সামান্যও বিচলিত নয় টের পেলে যখন কাচ আর রক্তের তামাশায় আহাজারি কিছু কুড়োবে ভাবছিলে।

বৃক্ষের আয়ু ফুরনো পাতাটি শুধু জানলো নুনের পুতুলেরা কেন ফেরে না কখনো সমুদ্র মাপতে গেলে।


 

অ্যানি সেক্সটন-এর কবিতার অনুবাদ

 

অভিজাত অথচ অসুস্থ শৈশব কোন নারীর প্রথমে বিষাদ, তারপর কবিত্বে উত্তরণ আর পরিশেষে অবশ্যম্ভাবী আত্মহননের কোন সূত্র হতে পারে কিনা, এই বিতর্কে যার নাম সবসময় উঠে আসবে তিনি অ্যানি সেক্সটন। ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র সুন্দরী কন্যা অ্যানির জন্ম ম্যাসাচুটেসটসে ১৯২৮ সালে। ছোটবেলায় তিনি একমাত্র অবিবাহিত পিসিকেই পেয়েছিলেন সঙ্গী হিসাবে। ঊনিশবছর বয়সে তাঁর বিবাহ হয় এলফ্রেড কায়োর সঙ্গে। যখন কায়ো কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যাস্ত, অ্যানি ফ্যাশন মডেল হিসাবে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। ১৯৫৩ এবং ও ১৯৫৫ সালে তিনি দুটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। প্রথম সন্তানের জন্মের পর থেকেই দুরারোগ্য হতাশায় আক্রান্ত হন যা মাত্র ৪৬ বছর বয়সে তাঁর আত্মহত্যার মধ্যে দিয়ে নিষ্কৃতিলাভ করে। মানসিক চিকিৎসালয়ে চিকিৎসা চলাকালীন ব্যাক্তিগত মনোবিদের পরামর্শে তাঁর কবিতা লিখতে আসা। ১৯৫৭ সালে বস্টনের লেখকগোষ্ঠীতে যোগ দিয়ে অ্যানি সমসাময়িক রবার্ট লওয়েল ও সিলভিয়া প্লাথের ঘনিষ্ট হয়ে ওঠেন। ১৯৬০ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ‘To Bedlam and Part Way Back’, ১৯৬৬ সালে তাঁর লেখা ‘Live or Die’ পুলিটজার পুরস্কার পায়। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করেন এবং অগণিত সম্মানের অধিকারী হন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফ্রস্ট ফেলোশিপ, লেভিসন প্রাইজ, আমেরিকান একাডেমি ফেলোশিপ, হাভার্ড সম্মান ইত্যাদি। যদিও তাঁর কবিতা অত্যাধিক ব্যাক্তিজীবনের প্রতি কেন্দ্রীকতায় আচ্ছন্ন বলে সমালোচিত হয়েছে কিন্তু নারীবাদ তথা বৈপ্লবিকতার উন্মেষে কবিতার জগতে সেক্সটনের নাম অনস্বীকার্য মাত্রাতেই উত্তীর্ণ।

অ্যানি সেক্সটন

* তার দেহকোষের জলাভূমি

(প্রাচীন আরবে কোন এক উপজাতির উপাস্য দেবীকে বলি উৎসর্গের আপাত উদ্দ্যেশ্যে মৃত পিতার পাশে তার যুবতী কন্যাকে জীবন্ত কবর দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিলো)

Harold Feldman
“Children of the Desert”
(Psychoanalysis and psychoanalytic Review, Fall 1958)

আত্মসংবরণের হাসি উপহার দিয়ে,
তার পাশে শুয়ে পড়াটাই শুধু গুরুত্বপূর্ণ ছিলো,
আর ছিলো এক ভাঁজে জড়িয়ে,
কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নেওয়া।
যেন আমরা রেশম,
মায়ের চোখ থেকে অস্তে পাঠানোর জন্য নি:শব্দে নির্ধারিত।
গিরিগুহা বা খাদক অথবা
অন্তর্গত জঠরের মতো কৃষ্ণগহ্বরটা
আমাদের গিলে নিল।
আমি শ্বাস ধরে রেখেছিলাম,
আর বাবা সেখানে ছিলো।
তার বুড়ো আঙ্গুল,
তার তৈলাক্ত খুলি,
তার দাঁত,
শস্যক্ষেত বা শাবলের মতো গজানো চুল।
অদ্ভুত না হয়ে ওঠা অব্দি
আমি তার চামড়ার শেওলার সঙ্গে শুয়েছিলাম।
আমার বোনেরা কখনো জানতেই পারবে না,
আমি কীভাবে নিজের সঙ্গে কলহে জড়িয়ে পড়লাম,
এমন জাহির করলাম,
যেন ঈশ্বর কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না,
কীভাবে আমি বৃদ্ধ গাছ পাথরের মতো
বাবাকে আঁকড়ে ধরলাম।

গর্ভপাত

একজন চলে গেছে যার জন্মানো উচিৎ ছিলো।

তখন ভূমি সদ্য তার মুখ উন্মুক্ত করছিলো,
প্রতিটি মুকুলই তার গ্রন্থি থেকে স্ফীত হয়।
আমি জুতোটা পাল্টে নিয়ে দক্ষিণে ভিড় জমাতে বেরিয়ে পড়েছিলাম।

আশমানি পর্বত পেরিয়ে যাচ্ছিলাম,
যেখানে পেনসিলভানিয়া কচি চুল পরা কুঁজ তৈরি করেই চলেছে।
ঠিক যেন একটা ছবিতে আঁকা বিড়াল।

সমস্ত রাস্তাগুলো ডুবে ছিলো ধোপার পাটার মতো ধূসরতায়।
যেখানকার ভিতে যথার্থই শয়তানের ফাটল ধরেছে।
একটা কৃষ্ণাভ কোটর যার থেকে স্রোতের মত কয়লা বেরিয়ে এসেছে।

একজন চলে গেছে যার জন্মানো উচিৎ ছিলো।

দূর্বাগুলো পিঁয়াজগাছের মতো কর্কশ আর শক্তিশালী,
আর আমি ভীষণ সন্দেহে কখন মাটিটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে,
আমি ভীষণ বিস্ময়ে কীভাবে নশ্বর কিছু প্রাণে বেঁচে থাকে।

পেনসিলভানিয়াতে আমার সঙ্গে একজন ছোট্ট-খাট্ট মানুষের দেখা হয়েছিলো,
কিন্তু সে তো রূপকথার সেই বিখ্যাত বামন রম্পলস্কিন না,
একেবারেই না,কোনওভাবেই নয়।
প্রেম থেকে যার সৃষ্টি,সে তার সম্পূর্ণটাই নিয়ে নিয়েছিলো।

উত্তরে ফেরার পথে,আকাশও শীর্ণকায়,তুচ্ছ হয়ে উঠেছিলো।
ঠিক যেমনভাবে একটা উঁচু জানলা কোনওদিকেই তাকিয়ে থাকেনা।
রাস্তাটা ছিলো একখণ্ড কাগজের মতো সমতল।

একজন চলে গেছে যার জন্মানো উচিৎ ছিলো।

অবশ্যই একটা মেয়েকে এইসব যুক্তি মৃত্যুহীন পরাজয়ের দিকে পথ দেখাবে অথবা জানিয়ে দেবে যা তুমি বোঝাতে চেয়েছিলে।

তুমি একটা ভয়ে পিছিয়ে যাওয়া মানুষ,
এই সেই সন্তান যাকে আমি রক্ত দিয়ে মুছে দিয়েছি।

 

শ্রেণীকক্ষে অন্ত্যেষ্টির গান

জনবিরল ক্লাসঘরে যেখানে তোমার অভিজাত মুখ আর তার উচ্চারণেরাই শেষ ও একমাত্র শব্দ,
তোমার সেই এলাকাতেই আমি এই ফুটন্ত প্রাণীটাকে খুঁজে পেলাম ।

তোমায় অবিন্যস্ত পেয়ে সে গোবরাটে জবরদখল চালাচ্ছিল,
অকাট্যভাবে বাসাও বেঁধে ফেলেছিলো,
যেন রাক্ষুসে এক ব্যাঙের বিরাট বড়ো পিণ্ড ।
তোমার পশমী পায়ের ব-দ্বীপের মধ্যে দিয়ে
আমাদের নিবিষ্টভাবে পরীক্ষা করছিলো ।

তা সত্বেও,তোমার চাতুরিকে আমার তারিফ করতেই হবে ।
তুমি অত্যন্ত শৃঙ্ক্ষলাপূর্ণভাবে মানসিক বিকারগ্রস্ত ।
আমরা আমাদের সাধারণ চেয়ারগুলোতে বসে থেকেই উসখুস করে উঠি ।
আর আমাদের প্রকৃত অবস্থাকে ফর্দে ফেলার ভান করি
তোমার বলিষ্ঠ ইন্দ্রজালের প্রভাবে ।
অথবা তোমার স্থূল,অন্ধ চোখেদের উপেক্ষা করি
বা সেই কুমারকে,
যাকে তুমি উদরস্থ করেছো বিগত দিনে,
যে ছিলো পন্ডিত,প্রবীণ,প্রাজ্ঞ ।

 

কুসুমিত চল্লিশা

আমি একটা পুত্রসন্তানের কথা চিন্তা করছিলাম,
জরায়ু তো কোন ঘড়ি নয়,
অথবা বাজতে থাকা কোন ঘন্টা,
কিন্তু জীবনের এগারোতম মাসে
শরীরের নির্ঘন্টে নভেম্বরের অনুভূতি এলো।
দিন দুয়েকের মধ্যে আমার জন্মদিন এসে পড়বে,
যেভাবে প্রতি জমির ফসল কেটে গোলাজাত করার সময়টা নির্দিষ্ট থাকে।
এইবার,আমার শিকার হলো মৃত্যু,
আর যা আমি চেয়েছি,
সেই রাতে তার দিকে ঝুঁকলাম।
বেশ,তবে তার কথাই বলা যাক,
জঠরের মধ্যে,সে সঙ্গেই ছিলো পুরোটা পথ।

আমি একটা পুত্রসন্তানের কথা চিন্তা করছিলাম।
তুমি কখনো অধিগত নও,
তোমার বীজ কখনো রোপণ বা উপড়ে ফেলা হয়নি।
অসংখ্য জননেন্দ্রিয়ের ভিড়ে তোমায় নিয়ে আমি ভীত হয়েছি।
তোমায় আমি নিজের চোখ উপহার দেবো না পুরুষটির?
তুমি ডেভিড আর সুসানের মধ্যে কোনটা হবে?
(যাদের কাহিনী শুনে এই দুটো নামকে আমি বেছেছি)
তোমার পিতারা যেরকম,তোমারও কি পুনরাবৃত্তি হওয়ারই সম্ভাবনা?
যার পায়ের মাংসপেশী মাইকেল এঞ্জেলোর ভাস্কর্য থেকে নেওয়া
আর হাতগুলো যুগোশ্লাভিয়ার।
যেন সেই দেশের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অসভ্য এক হালচাষি,
যেন জীবন নিয়ে ফুলে-ফেঁপে ওঠা উদ্বর্তিত কেউ-
এর পরেও সুসানের চোখ দিয়ে এই সবকিছু দেখতে পাওয়া কি সম্ভব?
তোমায় বাদ দিয়ে এই সমস্ত কিছু
দুটো দিনের রক্তে ভেসে গেছে।

আমি নিজেও তো অদীক্ষিত হিসেবেই সরে যাবো,
তৃতীয় কন্যাসন্তানকে তারা পরোয়া করবেনা।
আমার সন্তের পরবের দিনে আমার মৃত্যু আসবে,
নামদিবসে খারাপ কী আছে?
সবাই তো সূর্যেরই এক একটি ফেরেস্তামাত্র।

নারী,
নিজেরই চতুস্পার্শে এক উর্ণ বয়ন করে চলেছ,
এক সূক্ষ্ণ ও জটিল বিষ,
বৃশ্চিক,
বদ মাকড়সা,
মরণ।

দুটো নামের ফেঁসো বাঁধা কব্জি আমার মৃত্যুর ঘোষনা করবে।
কাঁচুলির মতো রক্ত জড়িয়ে থাকবে ফুটে উঠতে,
একজন বামে আর অপরজন দক্ষিণে,
এই উষ্ণ ঘরটা রক্তের এলাকা,
দরজাগুলোর কব্জা খোলা রাখো।

দুটো দিন তোমার মৃত্যুর জন্য,
আর দুটো দিন আমার মৃত্যু না হওয়া অব্দি।

ভালবাসা… এক রক্তিম ব্যাধি,
বছরের পর বছর ডেভিড তুমি আমায় উন্মাদ করে রেখেছো।
ডেভিড না সুসান?ডেভিড,শুধুই ডেভিড।
পূর্ণ আর বিভ্রান্ত,রাতের অন্ধকারে হিস্ হিসে শব্দ শোনা যায়,
যার কখনো বয়স বাড়েনা।
বছরের পর বছর,
আমার গাজর,আমার বাঁধাকপি,
সমস্ত নারীর আগে আমি তোমায় অধিকারে নিতে পারতাম,
তোমার নাম নিয়ে,
তোমায় ‘আমার’ ডেকে।

 

সমগোত্রীয়া

আমি একট ভূতে পাওয়া ডাইনি,
এখন বাইরে চলে এসেছি,
হানা দিচ্ছি কালো হাওয়ায়,
রাত ক্রমশঃ আরও দু:সাহসী করে তুলছে,
অশুভ স্বপ্নের ফেরি করছি,
সরল গৃহস্থালি থেকে ঝাঁকি দিয়ে
তুলে নিয়েছি নিজেকে,
সাময়িক অব্যাহতির তাড়নায়।
আলোর পর আলো
একাকিত্বে ডুবিয়ে দেয়,
বারোটা আঙ্গুল,অস্থিরমতি।
এই জাতের মেয়েরা ঠিক মেয়ে নয়,
বাস্তবিকই,
আমি এই রকমের।

আমি অরণ্যের মধ্যে উষ্ণ কন্দর খুঁজে পেয়েছি,
তাদের ভরিয়ে দিয়েছি ধাতব তৈজস,
ভাস্কর্য আর মাচা দিয়ে।
যেখানে অনেক গোপন কুঠুরি,রেশম আর অসংখ্য জিনিষপত্র।
আমি কৃমিকীটদের সান্ধ্যভোজের ব্যবস্থা করেছি যতবার,
দুষ্টু পরীরা ঘ্যান ঘ্যান করতে করতে
সব শৃংখলাকে লন্ডভণ্ড করে দিয়েছে।
এই প্রজাতির মেয়েরা ভুল বোঝার শিকার হয়।
আমি এই রকমের।

ওহে চালক,আমি তোমার গাড়িতে পীড়িত হয়েছি।
যে যে গ্রামের পাশ দিয়ে তুমি গেছ,
আমার নগ্ন হাতগুলোকে তাদের দিকেই দুলিয়েছি।
শিখতে চেষ্টা করেছি শেষ উজ্জ্বল যাত্রাপথগুলোকে,বাঁচতে,
অথচ,তোমার আবেগ তখনও আমার উরু কামড়ে ধরে ছিলো,
আর তোমার আবর্তে আমার পাঁজরগুলো সশব্দে ভাঙছিলো।
এই ধরনের মেয়েরা মরে যেতে লজ্জা পায়না,
আমি এই রকমের।

সোনালী চক্রবর্তী
সোনালী চক্রবর্তী

সোনালী চক্রবর্তী। কবি, অনুবাদক ও সম্পাদক। জন্ম ভারতের বারাণসীর পীতাম্বর পুরায় আশির দশকের শেষ ভাগের মাঘী পূর্ণিমায়, সুনীল চন্দ্র চক্রবর্তী ও সবিতা চক্রবর্তীর একমাত্র সন্তান। বেড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি, দার্জিলিং ও কার্শিয়াং মিলিয়ে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। ২০১৬ সালের...